বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই বিজ্ঞানীরা বস্তুর ধর্ম ও আচরণ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা পেয়ে যান। তারা বুঝতে পারেন কিভাবে পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, পৃথিবীর চারপাশে কিভাবে বাতাস বয়ে চলছে কিংবা কিভাবে বাষ্পীয় শক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রেনের মত বিশাল যন্ত্র চালানো যায়।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জনক হিসাবে খ্যাত ম্যাক্স প্লাঙ্ক ১৯০০ সালের দিকে কৃষ্ণ বস্তু বিকিরণের সমাধান করেন। পরবর্তীতে আইনস্টাইন প্লাঙ্কের এই সুত্র কাজে লাগিয়ে ১৯০৫ সালে “ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট” এর ব্যাখ্যা দেন। আইনস্টাইন এবং প্লাঙ্কের আবিষ্কার থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ (যেমন- আলো) আসলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণায় বিভক্ত এবং প্রতিটি কণায় নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি থাকে। এই বিস্ময়কর আবিষ্কার আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। কারণ এর আগে আলোকে নিরবচ্ছিন্ন স্রোত বলে ধারণা করা হত।
এই কোয়ান্টাম থিওরি ব্যবহার করে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলতে থাকে। যার ফলাফল হিসাবে বের হতে থাকে অবিশ্বাস্য সকল নতুন তথ্য। পরমাণু দ্বারা আমাদের সম্পূর্ণ জগত গঠিত, অথচ পরমাণুর নিজস্ব জগত আমাদের পরিচিত জগত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইলেকট্রনের মত অতি ক্ষুদ্র পারমাণবিক কণাগুলো নির্দিষ্ট পরিবেশে একই সঙ্গে একাধিক স্থানে থাকতে পারে, যাকে বলা হয় সুপারপজিশন। শুধু তাই নয়, এই ক্ষুদ্র কণার জগতে দূরত্ব কোন সমস্যা নয়। ইলেকট্রনের মত পারমাণবিক কণাগুলো যদি একে অপরের সাথে সংযুক্ত হতে পারে, তাহলে তারা হাজার হাজার মাইল দূরে থাকলেও একে অপরের খবর তাৎক্ষণিকভাবে জেনে যেতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় এনট্যাঙ্গলমেন্ট।
কণাদের মাঝে এত “অতিপ্রাকৃতিক” বৈশিষ্ট্য থাকলেও আমরা বাস্তব জগতে এমন কিছু কেন দেখিনা? কারণ অতি ক্ষুদ্র কণাগুলো শুধু তখনই এমন অবিশ্বাস্য কাজ করতে পারবে যখন তাদেরকে “পর্যবেক্ষণ” করা হবে না অর্থাৎ যখন কেউ তাদেরকে দেখবে না বা পরিমাণ করবে না। একটি ইলেকট্রনকে যখন কেউ পর্যবেক্ষণ করবে না তখন সেটি তার সম্ভাব্য সকল স্থানে একই সাথে বিরাজমান থাকবে। কিন্তু যখনই তাকে পর্যবেক্ষণ করা হবে তখনই সেটি শুধু একটি স্থানে অবস্থান করবে।
ইলেকট্রনের মত অতিক্ষুদ্র কণার এমন বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য কাজে লাগানো গেলে আমাদের প্রযুক্তিতে বিপ্লব দেখা দেবে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে নতুন যুগের সূচনা হবে। তথ্য জমা রাখা বা ইনফরমেশন স্টোরেজের উদাহরণ দেখলেই আমরা বুঝতে পারবো যে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার কত বেশি শক্তিশালী।
আমাদের পরিচিত ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে তথ্য জমা রাখা হয় মূলত ইলেকট্রিক সুইচের মাধ্যমে। এই ইলেকট্রিক সুইচগুলোর মান হয় 0(শূন্য) অথবা 1(এক) হতে পারে। এই 0 অথবা 1 এর মানকে বলা হয় বিট। আমাদের ফোন বা কম্পিউটার/ল্যাপটপে একটি সুইচে একটি বিট থাকতে পারে। ইলেকট্রিক সুইচগুলো ট্রানজিস্টর নামে পরিচিত। অসংখ্য ট্রানজিস্টরে অসংখ্য বিট থাকে এবং এই বিটগুলোর নির্দিষ্ট ধারা (Sequence) এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন তথ্য জমা রাখা যায়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে ব্যাপক উন্নয়ন আনা সম্ভব। বর্তমানে একটি বিটের মান হয় 0 অথবা 1 হতে পারে, কিন্তু কোয়ান্টাম সুপারপজিশনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে একটি বিটের মান একই সঙ্গে 0 এবং 1 হতে পারবে! কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিটকে বলা হয় কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিট।
কিউবিটের ফলে আমরা কি উপকার পাবো? একটি কাল্পনিক উদাহরণ দেখা যাক। আমাদের পরিচিত কম্পিউটারে কয়েক বিলিয়ন বিট থাকে। আমরা যদি একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করি যাতে মাত্র ৪০০ টি কিউবিট রয়েছে, তাহলে কি সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে আধুনিক কম্পিউটারের চেয়ে বেশি তথ্য প্রসেস করা সম্ভব! অদ্ভুত হলেও উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, মাত্র ৪০০ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের কয়েক বিলিয়ন বিটের কম্পিউটারের চেয়ে উন্নত। এতোটাই উন্নত যে সেই ৪০০ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সকল তথ্য পৃথিবীর সকল কম্পিউটারেও স্টোর করা সম্ভব হবে না। ৪০০ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সকল তথ্য জমা রাখার জন্য যতগুলো কম্পিউটারের প্রয়োজন হবে, তত সংখ্যক পরমাণুও আমাদের দৃশ্যমান জগতে নেই! আমাদের পরিচিত বা ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটার যে কাজ করতে হয়তো আজীবন লাগিয়ে দেবে, সেই কাজ মাত্র কয়েকশ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার করতে সক্ষম হবে।
বিস্ময়কর এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা নিয়ে তাই গবেষণা করে যাচ্ছে পৃথিবীর বড় বড় সকল টেক কোম্পানি। গুগলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছেন একদল বিজ্ঞানী। TEDxUCLA এর এক সেমিনারে গুগলেরতৈরি কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে আলোচনা করেন গুগলের এক বিজ্ঞানী ড. আলিরেজা শাবানী। ড. আলিরেজা এবং তাদের টিম মিলে ৯ কোয়ান্টাম বিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছেন।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অদ্ভুত নিয়ম অতিক্ষুদ্র কণার ক্ষেত্রে মেনে চলে। কিন্তু এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের চিপ পারমাণবিক কণার তুলনায় বিশাল আকৃতির। তাহলে কিভাবে এতো বড় একটি চিপ কিউবিট বজায় রাখতে পারে? ড. আলি রেজা এর উত্তরে বলেন, শুধু আকৃতি নয় বরং তাপমাত্রাও কোয়ান্টাম ফিজিক্সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতি নিম্ন তাপমাত্রায় বিশাল আকৃতির বস্তুও কোয়ান্টাম ফিজিক্সের নিয়ম মেনে চলে। তাই তাদের তৈরি কোয়ান্টাম সার্কিটকে বিশেষ ফ্রিজের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করা হয়। এই বিশেষ ধরনের ফ্রিজের মাধ্যমে যে কোনো বস্তুকে পরম শূন্য তাপমাত্রার প্রায় কাছাকাছি পর্যন্ত ঠাণ্ডা করা সম্ভব।
ড. আলি রেজা তার বক্তৃতায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিছু ব্যবহারের কথাও উল্লেখ করেন। প্রকৃতিতে নাইট্রোজেন চক্রের একটি ধাপ হচ্ছে বায়ু থেকে মাটির কিছু ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্রহণ করে এবং সেটিকে অ্যামোনিয়ায় পরিনত করে। ব্যাকটেরিয়া কোন পদ্ধতিতে নাইট্রোজেনকে অ্যামোনিয়ায় রূপান্তরিত করে তা আমাদের এখনো অজানা। এটি জানা গেলে আমাদের পক্ষে স্বল্প খরচে অ্যামোনিয়া তৈরি করা সম্ভব হবে। এই সমস্যা সমাধান করার জন্য যে রাসায়নিক সমীকরণের সমাধান করা দরকার তা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে। স্বল্পমূল্যে অ্যামোনিয়া তৈরি করা গেলে কৃষিকাজে ব্যবহৃত সারের দাম ব্যাপকহারে কমে যাবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতার সমাধান বের করা যাবে, উন্নত ওষুধ আবিষ্কার করা যাবে, স্বল্প শক্তিতে চলা গাড়ির ব্যাটারি বানানোসহ অনেক কিছুই করা সম্ভব হবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কয়েকটি দারুণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা শুরুতে শুনেছি (সুপারপজিশন, এনট্যাঙ্গলমেন্ট)। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের আরেকটি দারুণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কিউবিট ম্যানিপুলেশন। আমাদের পরিচিত ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের বিট নিয়ে কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হয় লজিক গেট। এই লজিক গেটগুলো কিছু বিট ইনপুট হিসাবে নেয় এবং আউটপুট হিসাবে একটি নির্দিষ্ট বিট দেয়। যেমন: একটি AND লজিক গেটের দুটি ইনপুট যদি হয় 1 এবং 0 তাহলে AND গেটের আউটপুট হবে 0 এবং এটি কখনোই অন্যথায় হবে না। বিভিন্ন ধরনের আউটপুট পাওয়ার জন্য তাই বিভিন্ন ধরনের লজিক গেট ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু একটি কোয়ান্টাম গেটে কিউবিট ম্যানিপুলেশন করে সম্ভাব্য সকল ধরনের ফলাফলই পাওয়া সম্ভব। কোয়ান্টাম গেটে কিছু কিউবিটের সুপারপজিশন ইনপুট হিসাবে নেওয়া হয় এবং সেই সুপারপজিশনের সম্ভাব্যতা (Probability) বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাল্টে দেয় বা Rotation করায় এবং নতুন সুপারপজিশনের সম্ভাব্যতা বের করে। শেষ পর্যন্ত কোয়ান্টাম গেটের মাধ্যমে আমাদের পছন্দসই আউটপুট বা ফলাফল বের করা সম্ভব। সঠিকভাবে সুপারপজিশন আর এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ব্যবহার করে প্রতিবারই আমাদের প্রয়োজনীয় ফলাফল বের করা সম্ভব শুধু একটি কোয়ান্টাম গেটের মাধ্যমেই।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো প্যারালালিজম। এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে একই সাথে একাধিক কম্পিউটেশন করা সম্ভব। যার ফলে একটি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের চেয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কয়েক লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী।
ব্রিটিশ পদার্থবিদ ডেভিড ডেউসের মতে, প্যারালালিজমের ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার একই সাথে মিলিয়ন কম্পিউটেশন করতে সক্ষম হবে, যেখানে আমাদের ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার মাত্র একটি করতে সক্ষম। প্যারালালিজমের সঠিক প্রয়োগ করা গেলে একটি ৩০ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রসেসিং ক্ষমতা আমাদের ল্যাপটপের সমান হবে (১০ টেরাফ্লপস)!
কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার মাধ্যমে হিলিয়াম গ্যাসের অদ্ভুত একটি বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেন। ল্যাবের পরিবেশে ঠাণ্ডা হিলিয়াম পরমাণু ব্ল্যাক হোলের এনট্রপির নিয়ম মেনে চলে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এবং জ্যাকব বেকেনস্টেইন ৭০ এর দশকে তাদের তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করেন যে ব্ল্যাক হোলে যখন কোন বস্তু প্রবেশ করে তখন সেটি ব্ল্যাক হোলের এনট্রপি বৃদ্ধি করে। একে বলা হয় “এনট্যাঙ্গেলমেন্ট এরিয়া ল”।
ইউনিভার্সিটি অব ভারমন্টের পদার্থবিদ আদ্রিয়ান দেল মায়েস্ত্রোর মত অনেক বিজ্ঞানী ধারণা করছেন যে, হিলিয়ামের উপর যথেষ্ট গবেষণা চালিয়ে ব্ল্যাক হোল বা কোয়ান্টাম থিওরি অব গ্র্যাভিটির বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব হবে। এমনকি কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের একটি গবেষণা দল এই বছরের শুরুর দিকে বড় আকৃতির কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার ব্লুপ্রিন্ট প্রকাশ করে। প্রফেসর উইনফ্রেইড হেনসিগারের নেতৃত্বে এই গবেষণা দল ট্র্যাপড আয়ন ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেন যা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত। এই ব্লুপ্রিন্ট বড় আকৃতির আর অধিক কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার গঠনে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করবে। প্রফেসরে হেনসিগারের দল এখন ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সে তাদের ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার কাজ করছেন।
প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, সহযোগিতায়- মোঃ শাকিফ ফেরদৌস এবং খায়রুন নাহার
বাংলাদেশ সময়:১৮৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
জেডএম/