যে খসড়া দেখা যাচ্ছে, তাতে রাইড শেয়ারিং শুধু ‘কার-ট্যাক্সি’র ক্ষেত্রেই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ঢাকায় ‘মোটর সাইকেল রাইড শেয়ারিং’-এর সংখ্যা কার-ট্যাক্সির চেয়েও বেশি।
এভাবে একদিকে রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে, অথচ অন্যদিকে সরকারের নীতিমালা সে অনুযায়ী প্রসারিত ও অবারিত হচ্ছে না। বরং আরও সংকুচিতই হচ্ছে। বলা হয়েছে, ঢাকার বাইরে মহাসড়কে এসব অ্যাপভিত্তিক সেবা চালু করা যাবে না। একথাতেই সংকোচনমুখি নীতিটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
সেতু-মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাইড শেয়ারিং নীতিমালা নিয়ে দু’মাস আগে প্রথম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সেখানে জনসাধারণ ও সরকারের সব বিভাগের মতামত নিয়ে বিশ্লেষণও হয়। দুই সপ্তাহ আগে মন্ত্রণালয়ের সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের নতুন সচিব যোগ দেওয়ার পর আরেকটি বৈঠক করে খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিসভায় তোলার জন্য প্রস্তুত করা হয়। সেটি এখন এখন মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের অপেক্ষায়।
তবে অ্যাপ কর্তৃপক্ষের (স্টেক হোল্ডার) সঙ্গে এখনও বৈঠক করেননি নীতিমালা প্রস্তুতকারীরা। এই ফাঁকে ঢাকায় অ্যাপ সেবার ‘নতুন নতুন দিক’ ও ‘সেবা পদ্ধতির হাল’ সম্পর্কে অবগত হবার সুযোগ থাকলেও সে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন না মন্ত্রণালয় ও নীতিমালা প্রণয়নকারীরা।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান জানান, ‘মন্ত্রণালয় খসড়া দেওয়ার পর বৈঠক করে তার চূড়ান্ত রূপটি দাঁড় করা হয়েছে। তবে মন্ত্রিসভায় তোলার আগ পর্যন্ত এটি চূড়ান্ত কিছু (চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ) নয়। ’
সবশেষ খসড়া অনুযায়ী, নীতিমালায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে অ্যাপে না আনা, আন্তঃজেলা ও মহাসড়কে রাইড শেয়ার না করার কথা বলা আছে।
নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোর ভাড়া নির্ধারণ। এটা ঠিক করতে পারেনি নীতিমালা প্রণয়ণ কমিটি। বিআরটিএর অনুমোদন দেওয়া ‘ট্যাক্সি সার্ভিসের ভাড়ার বেশি হতে পারবে না রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়া’-এমনটি বলা হয়েছে।
এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসকে। এতে অস্পষ্ট রয়ে গেছে মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়ার বিষয়টি।
এদিকে উবারসহ অন্য রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলোতে এখন যে ভাড়ার হার তা বর্তমান ট্যাক্সি সার্ভিসের চেয়ে কম হলেও তা আরও কমানোর কোনো পন্থা আছে কিনা বা তা থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় কিভাবে হতে পারে, সে বিষয়টি নীতিমালায় নেই।
খসড়া পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৩-এর ৩ অনুযায়ী ‘রাইড শেয়ারিং’ সার্ভিস এলাকা ঠিক করা হয়নি। এই সেবা কতদূর বিস্তৃত হবে তা-ও বলা হয়নি। মহাসড়কে চলতে দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকার ভেতরে সীমানা কি হবে তা-ও বলা হয়নি।
এদিকে আবার চট্টগ্রামে রাইড শেয়ারিং চালু হয়ে গেছে। সিলেটেও চালু হওয়ার পথে বলে জানা যাচ্ছে।
রাইড শেয়ারিং নীতিমালার ভূমিকায় লেখা হয়েছে, যানজট নিরসনে এটি ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন গাড়ি না কিনে রাস্তায় থাকা গাড়িগুলো দিয়েই এ সেবা বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছে। আবার নীতিমালায় ২০০ গাড়ি থাকতে হবে অ্যাপস প্রতিষ্ঠানের-এটাও বলা হচ্ছে।
অনুচ্ছেদ ৩ এর ৪ অনুসারে, কমপক্ষে ২০০ মোটরযান প্রয়োজন রাইড শেয়ারিং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের। এতে অ্যাপ প্রতিষ্ঠানগুলো উৎসাহিত হয়ে ২০০টি মোটরসাইকেল কিনে রাইড শেয়ারিংয়ে নামবে। তখন রাস্তায় আরও গাড়ি বাড়ার আশংকা তৈরি হবে, যা নীতিমালার ভূমিকার বিরোধী।
আবার ২০০ গাড়ির লাইসেন্স নিয়ে অ্যাপ প্রতিষ্ঠানগুলো চালাবে কয়েক হাজার গাড়ি। যার হিসেব পাবে না বিআরটিএ। এখানিও থাকছে আয়কর ফাঁকি দেবার সুযোগ।
আবার এটি প্রাইভেটকার, ট্যাক্সি না মোটর সাইকেলভিত্তিক অ্যাপ প্রতিষ্ঠান, কাদের জন্য এ দু’শ’ যান, তারও স্পষ্ট উল্লেখ নেই নীতিমালায়।
অনুচ্ছেদ ৩ এর ৫ অনুসারে, সিএনজিচালিত অটোরিকশাও রাইড শেয়ারিং করতে পারবে। কিন্ত পরে অটোরিকশাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
যুক্তি দেখানো হয়েছে, সরকারের বেঁধে দেয়া মিটার পদ্ধতি এখানে চালু আছে। কার্যত এই মিটারে সিএনজি আর চলে না। অ্যাপভিত্তিক সেবা আসার পর সিএনজি অটোরিক্সাগুলো ট্রিপ পাচ্ছে না। এখন তারাও অ্যাপে চলে আসছে।
অনুচ্ছেদ ৩ এর ৮ অনুসারে, মোটরযানের মালিক ও চালক কমপক্ষে ৩ মাস সময় অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত এক অ্যাপ ছেড়ে অন্য কোন রাইড শেয়ারিং অ্যাপে যেতে পারবে না। এ ধারণাটিও ভুল। কেননা স্মার্টফোনে একসঙ্গে একাধিক অ্যাপ ইনস্টল করা যায়।
অনুচ্ছেদ ৩ এর ১১ অনুসারে নতুন ক্রয়কৃত মোটরযান এক বছর অতিক্রান্ত না হলে রাইড শেয়ারিংয়ে আসতে পারবে না। একজন মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট কার আরোহীকে রাইড শেয়াংরিংয়ের জন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। এতে নতুন গাড়ির আরামদায়ক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে মানুষ। মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে পুরাতন মোটর সাইকেল নামানো হতে পারে।
অনুচ্ছেদ ৪ এর ১১ অনুসারে অ্যাপে একজন যাত্রী গাড়ির চালকের সব তথ্য দেখতে পারবেন বলে বলা হয়েছে। কিন্তু যাত্রীর বিস্তারিত পরিচয় চালকের দেখার সুযোগ নেই। এটিও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। একজন অপরাধী পরিচয় গোপন করে অ্যাপ দিয়ে গাড়ি ব্যবহার করে সহজেই যাতায়াত করতে পারবে।
অনুচ্ছেদ ৫ এর ১ অনুসারে, অ্যাপ প্রতিষ্ঠান বিআরটিএতে রেজিস্ট্রেশন করবে এক লাখ টাকা দিয়ে। প্রতিবছর নবায়ন ফি হবে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু কতটি গাড়ি রাইড শেয়ারিং করবে তার কোনো সংখ্যা বা তথ্য দেয়া হয়নি। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুচ্ছেদ ৫ এর ৭ অনুসারে, একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রযু্ক্তি প্রতিষ্ঠানে যেতে হলে ‘ডি এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট’ র কথা বলা হয়েছে। এটিও হাস্যকর। কারণ স্মার্টফোনে অ্যাপটি আনইন্সটল করে ফেললেই এ কাজ হয়ে যায়।
অনুচ্ছেদ ৬ এর ৩ অনুসারে, মোটরসাইকেলকে ৮০০ ও অন্যান্য মোটরযানকে ১২০০ টাকা দিয়ে বিআরটিএ থেকে ‘এনলিস্টমেন্ট সাটিফিকেট’ নিতে হবে। এখানে প্রাইভেট কার ও মোটর সাইকেলের মধ্যে পার্থক্য ধরা হয়েছে মাত্র ৪০০ টাকার। বাস্তবে আয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য অনেক।
অনুচ্ছেদ ৭-এ ছিলো ভাড়ার বিষয়। যার কোনো সমাধান নেই নীতমালায়। মোটর সাইকেল অ্যাপগুলো এরই মধ্যে প্রতিযোগিতায় গিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। নতুন কোনো অ্যাপ এলেই আবার নতুন করে ভাড়া বাড়ছে।
আর রাইড শেয়ারিং অ্যাপ প্রতিষ্ঠানগুলো বাইকারদের বা চালকদের কাছ থেকে আয়ের কতভাগ কমিশন কেটে রাখবে, সে বিষয়েও কোনো তথ্য বা দিক নির্দেশনা নেই নীতিমালায়।
বাংলাদেশ সময়:১৬১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৭
এসএ/জেএম