ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

সামাজিক মাধ্যমগুলোর বিধিমালাই অপরাধীদের ‘রক্ষাকবচ’

শাওন সোলায়মান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩১ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০২১
সামাজিক মাধ্যমগুলোর বিধিমালাই অপরাধীদের ‘রক্ষাকবচ’

ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথাকথিত নিজস্ব বিধিমালাই ডিজিটাল অপরাধীদের জন্য ‘রক্ষাকবচ’ হিসেবে কাজ করছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর হঠকারিতা এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তথ্য বিনিময় না করার প্রবণতা- এই দুই কারণে আইনের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে অপরাধীরা।

আর তাই বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেরও দরকার নিজস্ব স্থানীয় আইন ও বিধিমালা।  

সম্প্রতি আলোচনায় উঠে আসা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে আইন প্রণয়নের বিষয়ে এমনটাই মত দিয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী এবং সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলানিউজকে বলেন, যখনই ফেসবুক বা অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কোনো কনটেন্ট নিয়ে কিছু বলা হয়, তারা একটা জিনিস দেখায়া দেয় আমাদের। তাদের নিজস্ব কমিউনিটি গাইডলাইনস। তারা ইউরোপ আমেরিকার সমাজের জন্য নিজেদের মতো করে যে গাইডলাইনস বানিয়েছে সেটা কি আমাদের দেশে চলবে? এই সমস্যার সমাধানে দরকার আমাদের নিজস্ব আইন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নিজস্ব গাইডলাইন বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে উলটো অপরাধীদের জন্য একরকম ‘রক্ষাকবচ’ বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ব্যারিস্টার ইহসানুল কবীর।

ব্যারিস্টার কবীর বাংলানিউজকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে এর দায় অবশ্যই অপরাধীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও নিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর স্থানীয় কার্যালয় খোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি, কোনো ধরনের অপরাধ বা আইনবিরোধী কাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত হলে এবং এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে তদন্তের স্বার্থে সহযোগিতা চাইলে তারা প্রায়ই তা প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করতো। ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ও প্রাইভেসির কথা বলে অপরাধীর তথ্য প্রদান করা থেকে বিরত থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো -যা কিনা প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করার ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়।

ভারতের উদাহরণ দিয়ে ইহসানুল কবীর আরও বলেন, গত মে মাসে ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত একটি বিধিমালা তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০০ এর অধীনে প্রণীত হয়, যা কিনা আইটি রুলস ২০২১ (ইন্টারমেডিয়ারিসদের জন্য গাইডলাইন ও ডিজিটাল মিডিয়া এথিকস কোড) নামে পরিচিত। বিধি প্রণয়নের পেছনে দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাতে যে কোন ধরনের অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়। দ্বিতীয়ত, তিন স্তর বিশিষ্ট অভিযোগ নিরসন পদ্ধতির সংযোজন করা যাতে ব্যবহারকারীদের যে কোন অভিযোগের দ্রুত ও কার্যকর প্রতিকার প্রদান করা যায়। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিনষ্টে নানা অসত্য তথ্য প্রচার করা হয়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই বিষয়গুলো প্রতিহত করার জন্য এবং লঙ্ঘনকারীদের আইনের আওতায় আনতেই সম্প্রতি আইটি রুলস ২০২১ ভারত সরকার প্রণয়ন করেছে। যদি কোন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে উপরিউল্লেখিত অপরাধ করে থাকে তাহলে আদলতের নির্দেশ অনুযায়ী ৭২ (বাহাত্তর) ঘণ্টার মধ্যে এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইবার নিরপত্তা অনুসন্ধানী সংস্থাকে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। যে কোনো সাইবার ঘটনা সংঘটিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি ‘কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’কে অবহিত করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী বাংলাদেশেও কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠনের বিধান রয়েছে। ২০২০ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধিতে টিম গঠনের প্রক্রিয়ার কথা বলা আছে।  

ভারতের নতুন বিধিতে ব্যবহারকারীদের অভিযোগ নিরসনের জন্য একজন প্রধান কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। তাছাড়া একজন কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে নিয়োজিত থাকবেন এবং আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তদন্তের স্বার্থে যাবতীয় তথ্য প্রদান করবেন। প্রতি মাসে কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন প্রকাশ করবে প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যাতে উল্লেখ থাকবে কি পরিমান ও ধরনের অভিযোগ দাখিল হয়েছিল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের বিধান আমাদের দেশে থাকলে নিঃসন্দেহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা উপকৃত হবেন এবং তাদের অভিযোগগুলোর সুনির্দিষ্ট প্রতিকার পাবেন।  

বর্তমানে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমূহের নিয়ন্ত্রনে কোন আইন না থাকায় মাধ্যমগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া, রাষ্ট্রীয় আইনের লঙ্ঘনজনিত কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে, তারা আরো অধিক মাত্রায় সচেতন হবে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হবে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট বা আইডি খুলতে হলে জাতীয় পরিচয় পত্র বা পাসপোর্টের মতো দলিল থাকার বিধান রাখা যেতে পারে বলেও মনে করেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সাইবার৭১ এর পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাবের। জাবের বলেন, যদিও একটু ভিন্নভাবে কিন্তু ইউরোপে এমন বিধান আছে। সেখানে কিছু বট (রোবটের সংক্ষিপ্ত রুপ) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি সম্বলিত ব্যবস্থা থাকে যেগুলো শনাক্ত করে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কেউ কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্ট বা মন্তব্য করেছে কি না বা সন্দেহজনক কোন শব্দের ব্যবহার করেছে কী না। যদি এমনটা শনাক্ত হয় তখন সেই আইডিকে ভেরিফিকেশন (যাচাই) এর জন্য বাছাই করা হয় এবং আইডি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। আইডির ব্যবহারকারীকে তখন তার জাতীয় পরিচয় পত্র বা পাসপোর্টের কপি বা তদ্রুপ অন্য কোন দলিল দিয়ে সেই আইডি ভেরিফাই করাতে হয়। এরপর যদি কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয় তখন সেই আইডি চালু হয়। পরবর্তীতে একই আইডি থেকে অপরাধমূলক কিছু হলে বা সন্দেহজনক কিছু হলে আইডির ব্যবহারকারীকে সহজেই ট্র্যাক করা যায়।  

অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীর পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মগুলোও যেন অপরাধের দায় বহন করে তার জন্য আইনে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন ব্যারিস্টার ইহসানুল কবীর। তিনি বলেন, প্রকৃত অর্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারাকারীদের যেমন দায় আছে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুরূপভাবে মাধ্যম সমূহের দায় আছে এমন কিছু যাতে প্রকাশিত বা প্রচারিত না হয় যা কিনা আইন বিরোধী ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারীকে যেমন অনায়াসে শনাক্ত করা যায় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়, তেমনি যে কোনো ধরনের আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রচার ও প্রকাশের জন্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন ও দণ্ডবিধির আওতায় মামলা করা যেতে পারে এবং শাস্তি প্রদান করা যায়। শুধু ব্যবহারকারীর ওপর আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সব দায় চাপিয়ে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দায়হীন থাকবে এটি এক ধরনের দায়মুক্তির ধারনা জন্ম দেয়; যা কখনও কাম্য নয়।  

ভারতীয় আইটি আইন ২০০০ এর ৭৯ ধারার মত বিধান বাংলাদেশে প্রণীত হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা যেমন সচেতন থাকবে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও এই মাধ্যমে আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রকাশ ও প্রচার রোধে সোচ্চার হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০২১
এসএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।