আদনান বারক। ২৩ বছর বয়সী এ ফিলিস্তিনি জেরুজালেমের ওল্ড সিটির বাসিন্দা।
আদনান তার মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে দেখছিলেন, ইসরায়েলি আরও সৈন্যের দল খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বারের সামনে দিয়ে যাতায়াতকারী প্রতিটি লোককে থামাচ্ছে; তল্লাশির পর তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাদের তল্লাশি করা হচ্ছিল- তারা সবাই ফিলিস্তিনি।
যা দেখেন আদনান, সেটি তার পছন্দ হয় না। তাই নিজের মাথা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে (না সূচক) ওই গেট পার হয়ে ওঠেন ফলের স্টল ও খাবার বিক্রেতায় ঠাসা সড়কে। মনে মনে বিদ্রূপ করেন, ‘এর কোনো মানে হয় না। ’
জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের মতো আদনানও বছরের পর বছর ইসরায়েলি সৈন্য ও পুলিশের হাতে হয়রানির শিকর হয়েছেন। আল জাজিরাকে তিনি বলেছেন, এখন আমি এসবে অভ্যস্ত। কোনো অনুভূতি নেই আমার।
গত শনিবার (৭ নভেম্বর) ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস। ইসরায়েলের দক্ষিণে সংগঠনটির হামলার পর দখল করে নেওয়া জেরুজালেমের নিরাপত্তা নিজেদের জন্য জোরদার করেছে। তারপর থেকে ওল্ড সিটির ফিলিস্তিনিরা নজিরবিহীন হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানান আদনান। তিনি এখন ওল্ড সিটির প্রাচীন ও দেয়াল পার হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমটি এ শহরের যত ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলেছে- তারা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সৈন্যরা প্রতিনিয়ত তাদের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে; তাদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা হয়। কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার, অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে অপমানসহ নানা কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় তাদের।
জনবহুল পরিবেশে তরুণ ফিলিস্তিনিদের যেতে নিষেধ করা হয়। ইসরায়েলিরা ধারণা করে, ফিলিস্তিনি পুরুষরা তাদের মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোর মাধ্যমে নানা ধরনের ইভেন্টে জড়িত থাকেন। এ ধরনের ইভেন্টগুলো গোপনে রেকর্ড করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা।
আদনান বারক বলেছেন, জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘকাল ধরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। ইসরায়েলিরা এটিকে সম্মিলিত শাস্তির নীতি হিসেবে দেখে। আমাদের সবসময় শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এখন সৈন্যরা আমাদের সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করছে।
আল জাজিরার একজন সাংবাদিক ওল্ড সিটির প্রাচীন দেয়াল এলাকাটি পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি দেখেছেন কীভাবে চুনাপাথরের দেয়ালে ঠেসে ধরে ফিলিস্তিনি পুরুষদের নিয়মিত তল্লাশি করা হয়।
সম্প্রতি এমন তল্লাশির নামে শারীরিক হয়রানির শিকার হন হামজা আফগানি নামে ওল্ড সিটির ২৭ বছর বয়সী এক ট্যুর গাইড। ফিলিস্তিনি এ তরুণ জানান, পুরুষদের পাশাপাশি এখানে নারীদেরও অপমান-হয়রানি করা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে (হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ) নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের পুশব্যাক করতে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। এ অবস্থায় হামজার মতো তরুণদের অসহায়ত্ব বোধ করা ছাড়া কিছু করার নেই।
হামজা বলেন, ধরে নিন আগে আপনি পেছনে ফিরে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু এখন তারা আপনাকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করবে। কারণ, এখানে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
ওল্ড সিটিতে এ ধরনের অপমান-নিগ্রহ প্রধানত অল্পবয়সী ফিলিস্তিনি পুরুষের সঙ্গে করা হয়ে থাকে। এর পেছনের কারণ, ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া দেখাতে উস্কে দেওয়া।
হামজা আরও বলেন, ইসরায়েলি সৈন্যরা জানে- ফিলিস্তিনি হিসেবে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম। তারা আমাদের অনুভূতিকে উস্কে দেয় যাতে আমরা পিছিয়ে পড়ি।
সারি একজন ২৪ বছর বয়সী শেফ। অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের একটি ট্রেন্ডি বার্গার রেস্তোরাঁয় কাজ করেন তিনি। প্রতি রাতে কাজ শেষে ওল্ড সিটিতে নিজের বাড়িতে ফিরতে ভয় পান। তিনি বলেন, আগের নিয়মিত অনুসন্ধানগুলি সহনীয় ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে পুলিশ ও সৈন্যদের কর্মকাণ্ড আমার পরিবারের সদস্যদের গভীরভাবে আঘাত করেছে। আমার বাড়িতে রাতে আক্রমণ করা হয়েছি। এ ঘটনা আমার বাবাকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। আমার পরিবার এখন আমাকে লুকিয়ে রাখতে চায়। আমাকে কাজে না যেতে অনুরোধ করে।
সারি আরও বলেন, ইসরায়েলি সৈন্যরা এখন যা চায় তাই বলে; তাই করে। তারা আমাদের দেখলেই চিৎকার করে; পরিবারকে হুমকি দেয়। যা ইচ্ছা তা-ই করছে। তাদের কিছু বলা যায় না। কারণ, কিছু বললেই সোজা থানায় যেতে হবে।
১৯৬৭ সালে সিরিয়া, মিশর ও জর্ডানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষে পূর্ব জেরুজালেম দখল করে ইসরায়েল। এর আগে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের তারা জেরুজালেমের পশ্চিমে অর্ধেক দখল করে নেয়। ১৯৮০ সালে ‘জেরুজালেম আইন’ পাস করে ইসরায়েল। এর মাধ্যমে তারা পবিত্র শহরটিকে ‘ইসরায়েলের রাজধানী’ হিসেবে ঘোষণা করে। যদিও এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২৩
এমজে