ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

আবেগের মহাকাব্যে ভাসছে চিলি

আহমেদ জুয়েল, আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১০
আবেগের মহাকাব্যে ভাসছে চিলি

দীর্ঘ ৬৮ দিন যে আকাশের নিচে খেলা করেছে অনিশ্চয়তা আর মৃত্যুর হিমশীতল বাতাস, সেখানে আজ ফুলে ফেঁপে উপচে পড়ছে মুক্ত জীবনের আনন্দ। মৃত্যুকে জয় করার আনন্দ।

পাঁজরে পাঁজরে ছড়িয়ে যাচ্ছে আবেগের মহাকাব্য।

সান হোসে খনি থেকে একের পর এক শ্রমিক মুক্ত হচ্ছেন আর ছড়িয়ে পড়ছে সেই আনন্দের ঢেউ। আর সেই ঢেউয়ের দোলায় দুলে উঠছে স্বজনের হৃদয়। গোটা পৃথিবী।

চিলির সোনা ও তামার খনিতে আটকে পড়া শ্রমিকদের সেই মৃত্যু জয়ের আনন্দে চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা পর্যন্ত সরাসরি উপস্থিত আছেন। চিলির নাগরিকদের সঙ্গে সেই খুশির স্রোতে ভাসছেন সমগ্র পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ।

গত ৫ আগস্ট চিলির ওই খনি দুর্ঘটনায় প্রায় ৭০০ মিটার মাটির গভীরে আটকে পড়েন ৩৩ শ্রমিক। খনির প্রধান পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের বেঁচে থাকার আশা ছিল একেবারেই ক্ষীণ। কিন্তু প্রযুক্তি আর চিলি সরকারের কার্যকর তৎপরতা তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে দুই মাসেরও বেশি সময়। আর আজ তারা একে একে মুক্ত হাওয়ায় বেরিয়ে এসে ফিরে পাচ্ছেন নতুন জীবন, ফিরে পাচ্ছেন মুক্ত আকাশ আর স্বজন-পরিজন।

যখন একজন খনি শ্রমিক পাইপের মধ্য দিয়ে ক্যাপসুলে করে বেরিয়ে আসছেন, তখন অন্যদের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র সবাই দুরু দুরু বুকে উৎকণ্ঠায় থাকছেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদেরও প্রিয়জন খনি থেকে বেরিয়ে আসবেন সেই আনন্দ যেন তারা বুকের মধ্যে চেপে ধরে আছেন। বেশি উল্লাস কিংবা আনন্দ করলে যদি অমঙ্গল হয় সেই ভয়েও তারা থাকছেন তটস্থ হয়ে।

আবেগ প্রকাশের ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছেন শ্রমিকদের স্বজনরা। কোনো কিছুই কথায় প্রকাশ করতে পারছেন না ভালোভাবে। শুধু তাদের চোখে মুখে চক চক করে উঠছে প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ।

একের পর এক খনি শ্রমিক উঠে আসছেন আর আবেগের সাগরে পরিণত হচ্ছে খনি এলাকা। হাততালি আর উল্লাসে ফেটে পড়ছেন চিলির মানুষ।

নারীরা এই ঘটনাকে সন্তান প্রসবের সঙ্গে তুলনা করছেন। সন্তানের জন্ম হওয়ার পর মা যেমন তার প্রসবের সব কষ্ট ভুলে যান, ঠিক তেমনি একজন করে শ্রমিক যখন বেরিয়ে আসছেন তখন তার আত্মীয়-স্বজন যেন প্রাণহীন দেহে ফিরে পাচ্ছেন প্রাণ। মুক্ত হচ্ছেন দীর্ঘ ৬৮ দিনের উৎকণ্ঠা আর মানসিক কষ্ট থেকে। বুকে বুক লাগিয়ে সেই আনন্দের উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছেন পাঁজরে পাঁজরে।

শনিবার যে মুহূর্তে উদ্ধার পাইপ গিয়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে তখন পরম আনন্দে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সেই ক্ষণটিকে সম্ভাষণ জানান শ্রমিকদের স্বজনরা।

উদ্ধার কাজ চলছে। যারা এখনও খনির মধ্যে আটকে আছেন তাদের স্বজনরা সেখানে একা একা বাকহীন সময় কাটাচ্ছেন। শুধু যখন একজন করে শ্রমিক মুক্ত হচ্ছেন তখন তার স্বজনরা ছুটে যাচ্ছেন আনন্দের ঝড়ো বাতাসে।

আটকে পড়া এক খনি শ্রমিকের বোন জুলেমি ব্যারিওস ৩৩ শ্রমিকের সম্মানে ৩৩টি পতাকা উড়িয়ে উৎকণ্ঠায় পাহাড়ে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। আবেগের শ্বাস ফেলে তিনি বলেন, আমার এখন একা থাকা দরকার। সবার কাছ থেকে এখন আমার দূরে থাকা দরকার, এমনকি আমার মেয়ের কাছ থেকেও। ভাইয়ের নিরাপদে ফিরে আসার জন্য মোমবাতি জ্বালিয়ে তিনি প্রার্থনা করছেন।

রেডক্রসের ক্যাম্প থেকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করা হচ্ছে, কিন্তু কেউই খেতে চাচ্ছেন না। যেন ক্ষুধা নেই কারও। তারা একে অপরকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনার ছেলে বা আপনার স্বামী কয় নম্বরে বের হবেন?

পুরো খনি এলাকায় চারটি বড় টিভি স্থাপন করা হয়েছে। শ্রমিকদের আত্মীয়-স্বজনরা পৃথিবীর সব ভুলে সেই টিভির দিকেই যেন তাকিয়ে আছেন। কখন বেরিয়ে আসবেন তাদের প্রাণ প্রিয় মানুষটি। কখন তাকে নতুন জীবনের আনন্দে জড়িয়ে ধরতে পারবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।