ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

তালেবানের রাষ্ট্রদূতকে ‘স্বীকৃতি’ চীনের, তাৎপর্য কী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪
তালেবানের রাষ্ট্রদূতকে ‘স্বীকৃতি’ চীনের, তাৎপর্য কী?

আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী ২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর তাদের সাবেক মুখপাত্র বিলাল করিমিকে চীনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। তিনিই হন বিদেশে তালেবানদের প্রথম জাতীয় দূত।

বিলাল করিমিকে নিয়োগ দিয়ে তালেবান বলেছিল, তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে আফগানিস্তানের ইসলামী শাসনতন্ত্রের সরকার স্বীকৃত রাষ্ট্রদূত। কিন্তু সে সময়
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অফিস এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তাছাড়া আফগানিস্তানের এ পদক্ষেপকে তারা গ্রহণ করেছিল কি না, সেটিও জানা যাচ্ছিল না।

পরে মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রকাশিত কয়েকটি ছবিতে দেখা যায়, বিলাল করিমি তার নিয়োগপত্র চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ইউ জিয়াওয়ংয়ে তুলে দিচ্ছেন।

সম্প্রতি জানা গেছে, বিলাল করিমিকে সরকারি দূত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বেইজিং। অর্থাৎ ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের দুই বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানের দূতকে প্রথম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিল চীন।

গত ৩০ জানুয়ারি বিলাল করিমিকে বেইজিংয়ে একজন সরকারি দূত হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এদিন তিনি তার নিয়োগ, পরিচয় ও যাবতীয় সরকারি নথিপত্র চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের হাতে তুলে দেন। যদিও বলা হচ্ছে, কূটনৈতিক শংসাপত্রের স্বীকৃতির মানে কাবুলের শাসকদের স্বীকৃতি নয়।

ওই দিন বেইজিংয়ে চীনা সরকার কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের কাছ থেকে তাদের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন শি। ওই অনুষ্ঠানে ৩০৯ জন কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন।

আল জাজিরা বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, নিয়োগের পর ২০২১ সালের নভেম্বরের শেষদিকে দায়িত্ব নিতে চীনে পৌঁছান বিলাল করিমি। কিন্তু সেসময় তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর বেইজিং তাকে সরকারি দূত হিসেবে ঘোষণা করে।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে গত মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি একটি বিবৃতি জারি করে। এতে বলা হয়, ‘কূটনৈতিক শংসাপত্রের স্বীকৃতি আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকদের বেইজিংয়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ইঙ্গিত দেয় না। ’

যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার পর দেশটিতে বিনিয়োগ শুরু করে চীন। এ ছাড়া দেশটিতে কিছু প্রকল্পও হাতে নেয়।

সেই ধারাবাহিকতায় দূতের এই স্বীকৃতির বিষয়ে বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাষ্ট্রদূতের স্বীকৃতির মাধ্যমে তালেবান আরও একটি জয় নিশ্চিত করলো। কারণ, তালেবানরা তাদের সরকারের জন্য বিশ্বজুড়েই দৌড়ঝাঁপ করছে। এই প্রেক্ষাপটে বেইজিং অস্বীকার করলেও তাদের পদক্ষেপ তালেবানদের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক জয় নিশ্চিত করে।

ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে তালেবানরা বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। এর পেছনে রয়েছে তালেবান সরকারের নিজস্ব কিছু গোঁড়ামি। নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার একটি বড় কারণ। এ ছাড়া পশ্চিমারাও আফগান সরকারের ক্ষমতায় থাকা তালেবানদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। যে কারণে, আফগানিস্তানের অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিলাল করিমিকে বেইজিংয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে চীনের গভীর স্বার্থ রয়েছে। আফগানদের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক যেখানে বৈরি, সেখানে চীন এ গোষ্ঠীটির সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে কেবল অর্থনৈতিক কারণে।

কেননা, ২০২৩ সালে বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানি তালেবান সরকারের সঙ্গে একাধিক ব্যবসায়িক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ২৫ বছর দীর্ঘ শত শত মিলিয়ন ডলারের তেল উত্তোলন চুক্তি। এসব চুক্তির আনুমানিক বিনিয়োগ মূল্য প্রথম বছরে দেড়শ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তী তিন বছরে সাড়ে পাঁচশ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) গবেষক জিয়াই ঝু বলেছেন, এই সম্পর্কের একটি ইতিহাস রয়েছে। তালেবানরা চীনা সরকারের অজানা কোনো সত্তা নয়। ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে যখন এ গোষ্ঠী প্যারিয়া সরকারে (বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন) ছিল, চীন তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে। এরপর তালেবানের উত্থান-পতনেও তাদের সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক বজায় রেখেছিল বেইজিং।

তিনি আরও বলেন, সে ধারাবাহিকতায় তালেবানের সঙ্গে বেইজিংয়ের কয়েক দশকের দীর্ঘ বাস্তবসম্মত সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের বর্তমান সম্পর্কের কারণেই এই পরিণতি; বিশেষত নিরাপত্তা। আফগানিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী হিসেবে চীনের নিজস্ব নিরাপত্তাও তালেবানের ওপর নির্ভর করে।

ঝো মনে করেন, কেবল বেইজিংই তালেবানের সঙ্গে এমন বাস্তবসম্মত সম্পর্ক ধরে রাখছে তা নয়। আফগানিস্তানের বেশিরভাগ প্রতিবেশী চীনের মতো একই অবস্থানে রয়েছে। তারা মনে করে তালেবানদের বিচ্ছিন্ন না করে তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন।

এ তালিকায় রয়েছে রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশ। তাদের তালেবানদের সঙ্গে সখ্য গড়ার ইচ্ছা কেবল মানবিক প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ নয়, কাবুলে তাদের কূটনৈতিক মিশন পুনরায় চালু করার চেষ্টায়ও দৃশ্যমান। এতে দুই পক্ষেরই বড় কিছু সুযোগ রয়েছে। সেটি হতে পারে অর্থ, ব্যবসা, বা বড় কোনো প্রকল্প।

এতে তালেবানদের লাভ বলতে ‘পশ্চিমের বৈরিতা’ থেকে কিছুটা সরে থাকা; বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞার আকারে। কেননা, সাহায্য-নির্ভর আফগানিস্তানের ওপর এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। চলতি বছর আফগানিস্তানে আনুমানিক ২৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। দেশটিতে এখনো ব্যাপক অনাহার ও বেকারত্ব রয়েছে।

একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, দেশটির ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ (আফগান জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ) চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। মার্চের মধ্যে এ সংখ্যা ১৫ মিলিয়নে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তা ছাড়া তাদের জিডিপিতে হ্রাসও চোখে পড়ার মতো। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক একটি শ্রম সংস্থার বলেছিল, তালেবানরা সরকারে আসার পর আফগানিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দেশটিতে ৯০ হাজারের মতো মানুষ চাকরি হারিয়েছে। যার ফলে পুরো দেশ ব্যাপক বেকারত্বের কারণ হয়েছে।

নয়দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো ও কাবুলে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায় মনে করেন, এসব সংকট মোকাবিলায় তালেবানদের প্রয়োজন ছিল সহযোগীদের। আর এখন তাদের সেটি আছে। যে কারণে আফগানিস্তান এখন তার পক্ষের একটি বড় শক্তির ওপর নির্ভর করতে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিস আল জাজিরাকে বলেছেন, তালেবানরা বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় বৈশ্বিক শক্তি; রাশিয়া ও ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক চায়। যুক্তরাষ্ট্র ‘বল খেলতে নারাজ হওয়ায়’ সুযোগ নিয়েছে চীন। দেশটি এখন তালেবানদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এত কিছুর মধ্যে তালেবান যে নির্ভার তা নয়। কেননা, শুধু চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করায় তালেবানকে ‘বিরাট মূল্য’ দিতে হতে পারে। বাহিস সতর্ক করে বলেন, চীনের কবলে পড়লে আফগানিস্তান অন্যান্য দেশগুলোর, বিশেষ করে পশ্চিমাদের ক্ষোভের বশবর্তী হতে পারে। আবার এও মনে হচ্ছে, দুই পক্ষই তাদের স্থানে সতর্ক। এখনই কোনো ‘খেলা শুরু হবে না’ বলেই মনে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, স্বীকৃতির হাহাকার সত্ত্বেও তালেবানরা এখনো চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। কারণ, তারা সচেতন; তারা বেইজিংয়ের দিকে যত বেশি আকর্ষিত হবে, রাশিয়া ও ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসারিত করতে দ্বিধা করবে। এতে খুব সংশয় তৈরি হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।