ব্রাজিলিয়ান অ্যামাজনের ছোট্ট শহর ইতাইতুবার এক জন যৌনকর্মী দায়ানে লেইতে। তবে তিনি কখনোই যৌনকর্মী হতে চাননি।
১৭ বছর বয়সে তার স্বামী হৃদরোগে মারা গেলে এবং শেষকৃত্যের জন্য অর্থ জোগাড় করতে না পারলে তিনি এই কাজে বাধ্য হন। এ সময় তার এক বন্ধু তাকে ব্রাজিলের পাড়া রাজ্যের ইতাইতুবা শহরে অবৈধ স্বর্ণখনিতে যৌনকর্মীর কাজ করে অর্থ যোগাড়ের পরামর্শ দেয়।
শেষকৃত্যের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করার পর, ১৮ বছর বয়সে দায়ানের প্রথম সন্তান হয়। গত ১৬ বছর ধরে, ইতাইতুবার অনেক নারীর মতোই, তিনিও মাঝে মাঝে খনিতে কাজ করেন। কখনো রান্না, কাপড় ধোয়া, বারকিপার বা যৌনকর্মী হিসেবে। এখন তার সাত সদস্যের পরিবার রয়েছে, যাদের তিনি এই কাজের মাধ্যমে সহায়তা করেন।
অ্যামজনের খনি এলাকাগুলোর জীবন অত্যন্ত কঠিন। বেশিরভাগ গ্রামই শুধু কাদা মাটির রাস্তা, একটি বার এবং একটি গির্জা নিয়ে গঠিত। তবে খনি শ্রমিকরা আরও দূরে কাঠ এবং ত্রিপলের তৈরি ঘরে বসবাস করে, যা সাপ এবং জাগুয়ারের মতো বন্যপ্রাণীতে ঘেরা। জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে পুরো এলাকায় অন্ধকার নেমে আসে। রান্নার কাজ করা নারীদেরও পুরুষদের সঙ্গে এই শিবিরে থাকতে হয়।
ব্রাজিলিয়ান সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখ পুরুষ এই সব অবৈধ খনিতে কাজ করেন। ‘গোল্ড নাগেট সিটি’ নামে পরিচিত ইতাইতুবায় কিছু নারী তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। তবে নারীদের জন্য সহিংস এবং আইনহীন খনি এলাকাগুলোতে যাওয়া এখনো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
খনিগুলোর দ্বারা পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি সবারই জানা থাকলেও এর সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন এবং মানব পাচারের মত মানবিক ক্ষতির বিষয়টি প্রায়শই অপ্রকাশিত থেকে যায়।
ব্রাজিলের খনি গ্রামগুলোতে প্রায় সময় নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটে, এমনকি হত্যা নতুন কিছু নয়।
গত বছর ২৬ বছর বয়সী রাইয়েলে সান্তোস নামের এক তরুণীর মরদেহ কুইউ-কুইউ স্বর্ণখনির কাছে তার বসবাসরত কক্ষে পাওয়া যায়। এই এলাকাটি গাড়িতে ইতাইতুবা থেকে ১১ ঘণ্টার পথ।
রাইয়েলের বড় বোন রাইলানে জানান, একজন পুরুষ তাকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন; পরে সেই ব্যক্তি তাকে খুঁজে বের করে পিটিয়ে হত্যা করে। রাইলানে বলেন, প্রতিদিন অনেক নারী মারা যায়, অনেক নারী। আমি খনিতে জন্মেছি, খনিতে বড় হয়েছি, আর এখন খনিতে বসবাস করতে ভয় পাই।
বিবিসিকে একজন সোনা ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, এসব খনি থেকে প্রাপ্ত অবৈধ সোনা সাধারণত লাইসেন্সধারী খনি সমবায়ের সোনা হিসেবে পুনরায় লেবেল লাগানো হয়। পরে রপ্তানি হয়ে গয়না, মোবাইল ফোন বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের উপাদানে ব্যবহৃত হয়।
ব্রাজিলীয় সোনার তিনটি প্রধান ক্রেতা হলো কানাডা, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য। ইউরোপে রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি সোনা এমন এলাকাগুলো থেকে আসে যেখানে অবৈধ খনন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
গত ১০ বছরে ব্রাজিলে অবৈধ স্বর্ণখনির আয়তন দ্বিগুণ হয়ে ২০২৩ সালে ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে, যা বৃহত্তর লন্ডনের চেয়েও বড় এলাকা। তবে এই এলাকায় কতজন নারী কাজ করেন বা কতজন অবৈধ খনি শ্রমিক রয়েছেন, তা কেউ জানে না।
প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার সরকারের সময় অবৈধ খনি বন্ধ এবং তাদের উৎপাদিত সোনা ক্রয় বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে স্বর্ণের উচ্চমূল্য অনেক পুরুষরা ভাগ্য যাচায়ে বার বার খনিতে ফিরেছেন।
দায়ানে খনি এলাকায় কাজ করা বন্ধ করতে চান, এই ঝুঁকি এবং কষ্ট তার শরীরের উপর প্রচুর প্রভাব ফেলছে। তবে তিনি শেষবারের মতো খনিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তার লক্ষ্য দুই থেকে তিন মাসের আয় দিয়ে একটি স্ন্যাকস বার চালু করবেন। তবে তিনি এও স্বীকার করেন, এই পরিকল্পনার সফলতার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
তিনি বলেন, যখনই তিনি একা বনে হাঁটেন, তখন তার সন্তানদের কথা মনে পড়ে এবং তিনি তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন।
দায়ানে আরও বলেন, আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব, যতক্ষণ পর্যন্ত পারি,কারণ আমি আশা করি একদিন আমার সন্তানরা বলবে: আমাদের মা অনেক পরিশ্রম করেছেন। তিনি আমাদের জন্য অনেক কিছু সহ্য করেছেন, কখনো হাল ছাড়েননি।
সূত্র: বিবিসি
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২৪
এমএম