সিরিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা দামেস্কের পথে অগ্রসর হওয়ার পথে একের পর এক শহর দখল করে নেয়। দামেস্ক দখল করে নিলে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালাতে বাধ্য হন।
বিদ্রোহীরা বিভিন্ন শহর দখলে নেওয়ার পাশাপাশি আসাদের কুখ্যাত কারাগারগুলো খুলে দিতে থাকে। ১৪ বছর ধরে গৃহযুদ্ধে জড়ানো দেশটিতে এক লাখের বেশি মানুষ নিখোঁজ হন।
ডিসেম্বরের উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় কারাগার থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসেন। সেখান থেকে বেরোনো অনেকেই ছিলেন দুর্বল ও কঙ্কালসার। তাদের অপেক্ষায় ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তারা কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন, কেননা তারা জানতেন না যে তাদের প্রিয়জন এখনো জীবিত।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া লোকেদের অনেকে আসাদের পালানোর খবর বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আর যারা আরও দীর্ঘ সময় ধরে বন্দি ছিলেন, তাদের অনেকে জানতেনই না আসাদ তার বাবা হাফেজ আল-আসাদের উত্তরসূরি হয়ে ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন।
দামেস্ক থেকে পাওয়া যাচাই করা ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, বহু নারী ও ছোট শিশুদের কারাগারের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। বিদ্রোহীরা সেই দরজাগুলো খুলে তাদের বলছিলেন, ভয় পেও না।
দামেস্ক এবং তার আশেপাশের এলাকায় অবস্থিত কুখ্যাত কারাগারগুলোতে বন্দিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো— তাদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল সেদনায়া কারাগার। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ২০১৭ সালে সেখানে মৃতদেহ সরিয়ে ফেলার জন্য একটি নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল।
রোববার সকালে কারাগারগুলোর দরজা ভেঙে দেন বিদ্রোহীরা। ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলো নিয়ে এখনো ভিন্ন ভিন্ন খবর পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলোয় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
কারাগারে দীর্ঘদিন থাকার পর মুক্ত হয়ে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ছবি মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয়। বন্দিদের কাহিনীগুলো অবাক করার মতো। পুরো গল্প বলতে হয়তো কয়েক বছর লেগে যাবে। এসব গল্প আসাদ পরিবারের অপরাধ-নির্যাতনের করুণ প্রমাণ হয়ে উঠবে।
কারাগার থেকে মুক্ত সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে দামেস্কে এসেছে একটি পরিবার। ১৪ বছর পর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বৃদ্ধ মা। এই পরিবারের এক হওয়ার ভিডিও সম্প্রচার করেছে আল-আরাবিয়া।
সেদনায়া কারাগারেরও কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, কারাগারের সেল থেকে ছোট শিশুরাও বের হচ্ছে। তারা তাদের মায়েদের সঙ্গে কারাগারে বন্দি ছিল।
গত শতাব্দীর আশির দশকে বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদের সময়ে বিদ্রোহ চলছিল। হামা শহরে বিদ্রোহে বিমান থেকে বোমা ফেলতে অস্বীকৃতি জানানোয় পাইলট রাগাদ আল-তাতারি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি মুক্তি পেলেন ৪৩ বছর পর।
এমন নির্যাতনের উদাহরণ আরও রয়েছে। তাল আল-মালোহি নামে এক তরুণী আটক হয়েছিলেন ২০১৯ সালে। রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্লগস্পটে সমালোচনা করায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাকেও জীবিত পাওয়া গেল।
সেদনায়া কারাগারে এক ব্যক্তিকে এমনই অসুস্থ দেখা যাচ্ছিল যে যিনি কাঁপছিলেন। তিনি নিজের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। কথা বলতেও তার কষ্ট হয়। পরিবার বলছে, ২০ বছর বয়সের মেডিকেল ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৩ বছর আগে তিনি গুমের শিকার হন।
২০১১ সালে আরব বসন্ত চলাকালীন সিরিয়ায় সরকারের বিরোধিতা করা বহু বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হন। ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি থেকে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী কারাবন্দিত্বকেই ভিন্নমত দমনের প্রধান উপায় হিসেবে দেখত।
যুদ্ধ তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসাদ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী, ডিটেনশন সেন্টার এবং কারাগারের বিশাল নেটওয়ার্ক ভয়ঙ্কর নির্যাতনের জন্য পরিচিত হয়ে ওঠে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, ব্যাপক পরিসরে নির্যাতন চালানো হতো।
সরকারের পক্ষ থেকে বছরের পর বছর ধরে অনেক পরিবারকেই জানানো হয়, তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কয়েক বছর আগেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেছে। অনেকের এখনো অসহনীয় অপেক্ষা চলছে। তারা হয়তো আশা করছেন, তাদের প্রিয়জনদের জীবিত পাওয়া যাবে।
দামেস্কের একটি বাসস্টেশনে মানবাধিকারকর্মী আবদুলকাফি আল-হামদো বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে নিজের পরিবার নিয়ে আলেপ্পো থেকে ইদলিবে পালিয়ে যান। হামদো বাস স্টেশনে অপেক্ষায় থাকা উদ্বিগ্ন পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলছিলেন। বাসগুলো মুক্তি বন্দিদের নামিয়ে দিচ্ছিল।
সেখানে এক নারী জানান, ২০১২ সালে তার ১৮ বছর বয়সী সন্তানকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে তিনি ছেলের সম্পর্কে কিছুই শোনেননি। তিনি বলছিলেন, সেখানে থাকা অনেক পরিবারেরই ভয় তাদের সন্তান মারা গেলেন কি না- এই নিয়ে। অনেক পরিবারেরই ক্ষীণ আশা— হয়তো তাদের সন্তান বেঁছে আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২৪
আরএইচ