শত ক্ষমাভিক্ষায়ও কাজ হলো না। উত্তর কোরিয়ার গোটা জাতির কাছে মাথানত করে তবেই ক্ষমা প্রার্থণা করেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের ওটো ওয়ার্মবিয়ার নামে মাত্র ২১ বছর বয়সের ছেলেটি।
স্রেফ কারাদণ্ড নয়, সশ্রম কারাদণ্ড। আর উত্তর কোরিয়া যার নাম দিয়ে কঠোর শ্রমের দণ্ড। কি হতে পারে সেই কঠোর শ্রম? হয়তো ওয়ার্মবিয়ার নিজেও এখন তা বুঝতে পারছে না।
তবে এতেই সে কান্নায় ভাসিয়েছে পিয়ংইয়ংয়ের এজলাস কক্ষ। বলেছে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো এই চুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার আন্ডার গ্রাজুয়েট ছাত্র ওয়ার্মবিয়ার উত্তর কোরিয়ায় এসেছিলো পর্যটক হিসেবে। ঘুরে ফিরে ফেরত চলে যাওয়ার দিনও এসে যায়। ওই দিনই ইয়ংগাকডো ইন্টারন্যাশনাল নামের যে হোটেলে সে ছিলো সেখানেই হোটেল স্টাফদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে সেখানে টানিয়ে রাখা একটি রাজনৈতিক প্রোপাগ্যান্ডাধর্মী পোস্টার চুরি করতে যায়। ধরা পড়ে গেলে তার জন্য সকল বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে এই চূড়ান্ত শাস্তির ব্যবস্থা।
কেন চুরি করতে গিয়েছিলো সে? তারও একটি ব্যাখ্যা সংবাদমাধ্যমের সামনে ও আদালতে দিয়েছে ছেলেটি। জানিয়েছে তার এক বন্ধুর মায়ের প্ররোচনায় এই কাজটি সে করেছে। ওই বন্ধুর মা যুক্তরাষ্ট্রে একটি চার্চের সদস্য। তিনিই ওকে পোস্টারটি চুরির জন্য প্ররোচিত করেন। তিনি বলেছেন, এটি নিয়ে যেতে পারলে তিনি তার চার্চের ট্রফি হিসেবে সাজিয়ে রাখবেন।
আর বিনিময়ে তাকে ১০ হাজার ডলার দামের একটি গাড়ি উপহার দেবেন। তাতেই সে লোভে পড়ে যায়।
ওয়ার্মবিয়ার জানায়, ওই চার্চের সদস্য, তার বন্ধুর মা তাকে বলেছিলেন, ব্যানারটি তারা চার্চের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে চান। আর এও বলেছিলেন, সে যদি ধরা পড়ে যায় আর যদি ফিরতে না পারে তাহলে তার মাকে কোনও একটি চ্যারিটেবল অনুদান থেকে ২ লাখ ডলার দেওয়া হবে।
চার্চটি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও’র অয়োমিংয়ে। আর সেখানেই ওয়ার্মবিয়ারের বাবা-মা থাকেন। তারা বলেছেন, ওয়ার্মবিয়ার আটক হওয়ার আগে পর্যন্ত তারা এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ছেলের মুক্তি চেয়ে উত্তর কোরিয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেও ফল পান নি এই বাবা-মা। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকেও তাকে স্বল্প শাস্তি দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু কিম জং উনের শাসন ব্যবস্থায় স্বল্প শাস্তি বলে কোনও কথা নেই। ওয়ার্মবিয়ারের জন্য তাই বরাদ্দ ১৫ বছরের কঠোর শ্রমদণ্ড। কেমন হবে সেই দণ্ড?
স্রেফ এক নরক যন্ত্রণা। সাধারণত জানা যায় না সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতি। সাবেক এক কারারক্ষীর গা হিম করে দেওয়া বর্ণনায় রয়েছে উত্তর কোরিয়ার এই কঠোরশ্রম কারাগারের কথা। হুয়াসং ক্যাম্প নামে পরিচিত একটি কারাগারের কাজ করতেন তিনি। সেখানে একটি কারাগারে ২০ হাজার বন্দি রাখা হয়। উত্তর কোরিয়ায় মোট রাজনৈতিক কারাবন্দির সংখ্যা ২ লাখের বেশি। এখানকার চিত্র নাৎসীদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গেই তুলনা চলে। বন্দিদের প্রাণরক্ষা এখানে কারারক্ষীদের মর্জি। তারা চাইলেই যে কেউকে মেরে ফেলতে পারে। স্রেফ গলায় রাবারের ফিতা পেচিয়ে সে হত্যা। কোনও জবাবদিহিতা নেই। আরেক ধরনের হিংস্র নৃশংস পদ্ধতি হচ্ছে-কারাবন্দিদের দিয়েই প্রথম গর্ত খুড়ে নেওয়া আর এরপর তার কিনারে চোখ বেঁধে দাড় করিয়ে মাথার পেছনে হাতুরি দিয়ে পেটানো। আর এতে অসহায় বন্দির যখন ত্রাহি ত্রাহি দশা তখন রক্ষীরা ফেটে পড়ে অট্টহাস্যে।
এখানে মাইনাস ২৫ সেলসিয়াসে কারাবন্দিতের ৭ মাইল হেঁটে তবেই কাজে যেতে হয়। তাদের না খাইয়ে না খাইয়ে এমন কাবু করে তোলা হয় যে সেভাবে হাঁটতে গিয়ে পথেই মরে পড়ে থাকে।
২০১৪ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে এক রাজনৈতিক বন্দির ভাষ্যে বলা হয়েছিলো, কারাগারে একদিন একটি সেলাই মেশিন ফেলে দেওয়ার অপরাধে তার একটি আঙুল কেটে নেওয়া হয়।
নির্যাতনের আরেকটি ধরনের নাম ‘পিজিয়ন টর্চার’। এতে হাত দুটো পেছনে হ্যান্ডকাফ পড়ানো থাকে। এরপর ঝুলিয়ে দেওয়া হয় যাতে দাঁড়ানো বা বসা না যায়।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসলে অধিকাংশ কারাবন্দিই আর এখান থেকে জীবিত বের হয়ে আসতে পারে না। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্তই তাদের ওপর নির্যাতন চলে।
এই কারাগারগুলো উঁচু করে বেড়া দিয়ে ঘেরা যা সার্বক্ষণিক বিদ্যুতায়িত থাকে উচ্চমাত্রার ভোল্টেজে। এছাড়াও রয়েছে কাঁটাতারের শক্ত বেড়া। কেউ যদি পালানো পথ খোঁজে রক্ষীদের ওপর নির্দেশ রয়েছে, স্রেফ গুলি করে মেরে ফেলো। আর সে জন্য তাদের পুরষ্কারও দেওয়া হয়। ছোট ছোট অপরাধের জন্য রেশন বাতিল করে বাড়তি খাটুনি আর একক বন্দিদশায় রাখা হয়। আমৃত্যু ভুখা থাকা এই জেলখানায় একটা সাধারণ ঘটনা। এতে বন্দিরা দুর্বল থাকে আর তাদের নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। আর যখন খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়, বন্দিরা তখন ক্ষুধা সহ্য না করতে পেরে পোকা-মাকড়, বন্য লতা-পাতা এগুলো খায়, কিংবা কারারক্ষী বা পশুদের খাবার চুরি করতে চেষ্টা করে।
আর উত্তর কোরিয়ায় এখন এসব কিছুই অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্রের ২১ বছরের তরুণ ওটো ওয়ার্মবিয়ারের জন্য।
উত্তর কোরিয়া যখন মার্কিন এই নাগরিকের জন্য এমন পরিনতি নিশ্চিত করলো ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের নির্বাহী আদেশে সই করলেন। যদিও দুটি ঘটনার একটির সঙ্গে অন্যটির কোনও যোগসাজশ নেই। নিষেধাজ্ঞার পেছনে গত জানুয়ারিতে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের নির্দেশে হওয়া পারমানবিক পরীক্ষাই দায়ী।
বাংলাদেশ সময় ১১০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৬
এমএমকে