ঢাকা: ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’- প্রতিদিন গণমাধ্যমে এই নামটি শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে আপনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে গেছেন। এই অধ্যায় শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরও অনেক বার তার চেহারা দেখতে হবে আপনাদের, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যা বলছে, রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেয়ে গণমাধ্যমে নিজের চেহারা দেখাতেই বেশি আগ্রহী। আলোচনায় থাকতে যে কারণে সচেতনভাবেই তিনি উদ্ভট আর আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক। সমালোচকদের ভাষায় এটা ‘আর্ন্ড মিডিয়া’।
তবে কিছু না করে ট্রাম্পের এই অর্জন নিঃসন্দেহেই প্রশংসার যোগ্য।
নিউইয়র্ক টাইমস’র হিসাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত মাসেই তার চেহারা এবং নাম যতবার গণমাধ্যমে এসেছে- তার অর্থমূল্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রচারণার প্রায় দ্বিগুণ।
আর্ন্ড মিডিয়া, মানে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচারণা এবং তাও কেবলমাত্র ‘প্রলাপ বকে’। এটি সত্যিকার অর্থেই ট্রাম্পের চতুরতার পরিচয়, বলছেন সমালোচকরা। কেবল তাই নয়, গালাগালির মধ্য দিয়ে ট্রাম্প ঠিকই পাঠক এবং দর্শকদের মনে তার জায়গা করে নিয়েছেন।
প্রচারণার জন্য অর্থ ব্যয় না করে, ‘বাজে কথা’ বলেও আলোচনায় থাকা যায়- তা প্রমাণ করেছেন ট্রাম্প। কেবল গণমাধ্যম নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চোখ রাখলেও দেখা যাচ্ছে, ‘ডিজিটাল ল্যান্ডস্পেস’ জুড়ে অশ্রাব্য গালাগালির মধ্যে দিয়ে আলোচনায় রয়েছেন এই রিপাবলিকান নেতা।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের মূল উদ্দেশ্য হয়তো নির্বাচনে জয়ী হওয়া নয়, জনগণের মনে তার নাম গেঁথে দেওয়া। তা সমালোচিত হয়ে হলেও।
যেমন, সম্প্রতি ‘ৠানডম অ্যাক্টস অব কাইন্ডনেস’ নিয়ে একটি সংবাদ মাধ্যম নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে। একদিনে সংবাদটি ১ লাখ ৭০ হাজার বার টুইট হয়। অন্যান্য কোম্পানির পাশাপাশি ওই কোম্পানিও সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে।
বিশ্বস্ত গণমাধ্যমে কোনো সংবাদ প্রকাশ হলে আগ্রহী পাঠকরাও শেয়ার করে থাকে। এমন ছক কেটে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তাই আলোচনায় আসতে তিনি বেছে নিয়েছেন ধর্ম-বর্ণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো। কারণ ট্রাম্প জানেন, এগুলো নিয়ে কথা বললে সাধারণ মানুষে মনে দাগ কাটবে।
গত ১০ মার্চ ট্রাম্প সোজাসাপ্টা মন্তব্য করেন, ‘ইসলাম আমাদের ঘৃণা করে। ’ এটাই প্রথম নয়। গত নভেম্বরে ক্যালিফর্নিয়ায় মুসলিম দম্পতির গুলির ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের ভ্রমণ নিষিদ্ধের দাবি জানান।
নিজের প্রচারণায় তিনি বেশ কয়েকবার বলেছেন, জঙ্গিদের পরিবারসমেত হত্যা করা উচিত এবং সিরিয়ায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করা উচিত।
তবে সমালোচনার জন্মটা তিনি প্রথম দেন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির সংস্কারের দাবি জানিয়ে। এরপর একে একে আক্রমণ করেছেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যাদের তিনি পছন্দ করেন না, তাদের সবাইকেই। এতে অর্জন যাই হোক, সমালোচনাটা তার গায়ে স্থায়ীভাবে লেপ্টে গেছে।
মুসলিম বিদ্বেষী মন্তব্য করে তিনি সমালোচিত তো হয়েছেনই, তার সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। মেক্সিকো থেকে সন্ত্রাসী আর ধর্ষক প্রবেশ করছে মন্তব্য করে দেশটির সঙ্গে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের দাবি তুলে পড়েছেন স্বয়ং পোপের রোষানলে। পোপ ফ্রান্সিস এতটাই ক্ষেপেছেন যে, ট্রাম্পের ধর্মবিশ্বাস নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
কটূক্তি আর বর্ণবাদী মন্তব্য করায় নিজের দলেও যথেষ্ট সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।
মেক্সিকোর সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট ফেলিপ কালডেরনো ও ভিসেন্ত ফক্স ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ট্রাম্প জনবান্ধব নেতা নন। তিনি স্বার্থবাজ। সবচেয়ে বড় কথা তিনি বর্ণবাদী ব্যক্তি।
তারও আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বর্ণবাদী বলেছিলেন ব্রিটিশ সংসদের সদস্যরা (এমপি)। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ট্রাম্পের যুক্তরাজ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার আহ্বান-সংবলিত একটি প্রস্তাব তুলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপিরা বলেন, তিনি (ট্রাম্প) একজন বর্ণবাদী নেতা, ভাঁড় ও মূর্খ। তার শহরের মেয়রও একই বললেন।
কেবল রাজনীতিবিদরাই নন, প্রযুক্তিবিদরাও ট্রাম্পকে চান না- তা ইতোমধ্যে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন তারা।
এছাড়ও প্রতারণার অভিযোগ তো তার বিরুদ্ধে ছিলোই। ২০১৩ সালে নিউইয়র্কের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক শ্নেইডারম্যান তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করেন, ট্রাম্প ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসে পাঁচ সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ৪০ মিলিয়ন ডলার (৭৮ টাকায় ডলার হিসাবে ৩১৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা) ঢেলেছে, যার এক চতুর্থাংশ গেছে সরাসরি ট্রাম্পের পকেটে।
সমালোচকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, নিজের দেশে ও দলে বহুল সমালোচিত হলেও সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ট্রাম্পের। তিনি আছেন বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট মন্তব্য আর কটূক্তি করে গণমাধ্যমকে আকর্ষণ করে সংবাদ শিরোনাম হওয়ার চেষ্টায়।
এদিকে, সমালোচিত হলেও আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান দলে প্রার্থিতার দৌড়ে থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তার ঝুলিতে জমেছে ৬৬১টি ডেলিগেট ভোট। নিজের দলে মনোনয়ন পেতে তার দরকার ১,২৩৭টি ডেলিগেট ভোট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত হিলারি আর ট্রাম্পের মধ্যেই নভেম্বরের দ্বৈরথটি হবে। আর সে দ্বৈরথেই মৃত্যু হবে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নের।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৬
এটি/আরএইচ