ঢাকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) আস্তানা গাড়া বিদেশি সাংবাদিকদের হঠাৎ করেই বাইরে বের হতে নিষেধ করা হলো।
তখনই সাংবাদিকরা আঁচ করেছিলেন খারাপ কিছুর। কিছু একটা নিশ্চয় ঘটতে চলেছে।
নেমে এলো রাত। ২৫ মার্চের রাত। ১১টা বাজতেই ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ সেই সাংবাদিকরা নিজ নিজ রুমের জানালা দিয়ে দেখলেন, ঘড়ঘড় আওয়াজে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রাজপথে নেমে এসেছে জলপাই রংয়ের ট্যাংক। সাঁজোয়া যানে চেপে রাজধানী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
তবে তখনো কেউ কল্পনা করতে পারেননি এর তাৎপর্য। এই এক রাতেই যে ঢাকায় ঝরে যাবে সাত হাজারেরও বেশি প্রাণ। আগুনে পুড়ে ছাই হবে অসংখ্য বাড়িঘর। গ্রেফতার হবেন মুক্তিকামী জনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা ছিলো ওই সাংবাদিকদের কল্পনারও বাইরে।
তবে সাংবাদিকদের মধ্যে একজন একটু সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। হয়তো ছিলেন একটু বেশি সাহসীও। যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। ছাদে উঠে পেছন দিকের দেয়াল টপকে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। আর তাই ২৬ মার্চ সকালে বিদেশি সাংবাদিক হিসেবে তিনিই প্রথম সাক্ষী হলেন পাকিস্তান বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরবর্তী দৃশ্যের।
পাকিস্তান বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের ঘটনা নিয়ে ডেইলি টেলিগ্রাফ ৩০ মার্চ প্রথম পৃষ্ঠায় ‘TANKS CRUSH REVOLT IN PAKISTAN: 7,000 slaughtered, Homes burned’ শিরোনামে সাইমন ড্রিংয়ের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনের প্রথম প্যারায় তিনি লেখেন, ‘ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত আর ভয়ার্ত শহরের নাম। ঠাণ্ডামাথায় পাকিস্তান বাহিনীর ২৪ ঘণ্টার নির্মম গোলাবর্ষণে পূর্ব পাকিস্তানে সাত হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে, বিশাল এলাকা এখন বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে আর স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের লড়াইয়ের নির্মম পরিণতি ঘটেছে। ’
বিশ্ববাসী এরই মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে, তার আলামত পেয়ে গেলেও এই প্রতিবেদনেই প্রথম তারা জানতে পারে, ‘সৃষ্টিকর্তা ও যুক্ত-পাকিস্তান’র নামে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কী নিষ্ঠুরতার পথেই না হেঁটেছে সেদিন।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ৮ পাকিস্তানি সাংবাদিককে দেশটির বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য ছিল, এখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে, তার কয়েকটি সরেজমিন প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমে ছেপে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করা। এই সাংবাদিকদের একজন ছিলেন পাকিস্তানি সংবাদপত্র মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ১৯৭১ সালের ১৮ মে তিনি লন্ডন চলে যান। সেখানে তিনি সানডে টাইমস পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তার সত্যরূপ তুলে ধরার প্রস্তাব করেন। পত্রিকা কর্তৃপক্ষও এতে রাজি হয়ে যায়। এরপর তিনি পাকিস্তান ফিরে যান। সেখান থেকে ১৩ জুন পরিবারসহ নিরাপদে আবারো লন্ডনে পৌঁছালে সানডে টাইমস তার প্রতিবেদন ছাপতে শুরু করে। প্রথম প্রতিবেদনটি যায় ‘GENOCIDE’ শিরোনামে। এ প্রতিবেদনটি সানডে টাইমস তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করে। এতে প্রথম প্যারায় মাসকারেনহাস লেখেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা মার্চের শেষ দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার মার্চের শেষ সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদ সংগ্রহের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, এটাই তার পেছনের বাস্তবতা। আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে পঞ্চাশ লাখ শরণার্থী কলেরা আর ডায়রিয়ার ঝুঁকি নিয়ে কেন ভারতে আশ্রয় নিল, তারও কারণ এটি।
সাইমন ড্রিং বা অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিশ্ব প্রথম পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিস্তারিত জানতে পারলেও ২৫ মার্চ কালরাত্রির ঘটনার খবর ২৭ মার্চই তাদের কাছে পৌঁছে যায়। বিশ্বখ্যাত বেশ কিছু পত্রিকা ২৭ মার্চ থেকে প্রতিদিনই পূর্ব-পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে।
এর মধ্যে ডেইলি টেলিগ্রাফ ছিলো এগিয়ে। ২৭ মার্চ পত্রিকাটিতে ২৫ ও ২৬ মার্চের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে দু’টি সংবাদ ও একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘CIVIL WAR FLARES IN E. PAKISTAN: Sheikh ‘a traitor’ says President’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গতকাল (২৬ মার্চ) থেকে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রটির এ প্রদেশে পূর্ব ও পশ্চিম পক্ষের এ সংঘর্ষে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। ’
এছাড়া ‘Jinnah’s dream of unity dissolves in blood’ শিরোনামের সংবাদ ও ‘PAKISTAN’S CIVIL WAR’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তেও ফুটে উঠেছে এই অঞ্চলে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিষ্ঠুরতার গাঁথা।
একইদিন অস্ট্রেলিয়ার দ্য এজ-এ প্রকাশিত হয় ‘DECCA BREAKS WITH PAKISTAN’ শিরোনামের একটি সংবাদ।
২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে তিনটি সংবাদ প্রকাশ করে। এগুলো হলো- ‘Army expels 35 foreign newsmen from Pakistan’, ‘Artillary used’ ও ‘Toll called high’।
Artillary used শিরোনামের সংবাদটিতে লেখা হয়, ‘স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে, তা দমনে নিরীহ-নিরস্ত্র বেসামরিক জনসাধারণের ওপর ভারী মেশিনগান ও কামান ব্যবহার শুরু করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) রাত থেকে এ হামলা শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার সড়কে বেরিয়ে এসেছে। গণআন্দোলনের কেন্দ্রগুলো, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তারা নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। ’
২৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে ডেইলি টেলিগ্রাফ একটি সম্পাদকীয় ও চারটি সংবাদ, নিউইয়র্ক টাইমস একটি, দ্য এজ চারটি এবং দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড সম্পাদকীয় ছাপে।
এসব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও তাদের সাংবাদিকদের কল্যাণেই ১৯৭১ সাল জুড়ে বিশ্ববাসী জানতে পারে, পূর্ব-পাকিস্তানে কী ঘটছে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নির্মম সিদ্ধান্তে এখানে কীভাবে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছে। মোট কথা পাকিস্তানিদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা অজানা ছিলো না আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের। ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতের কাহিনী পুরো বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্রিকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৬
আরএইচ/আরআই