ঢাকা: অমূল্য রত্ন পাথর ‘কোহিনূর বৃটেনের’ ভারত সরকারের এমন বক্তব্যে বেশ ‘অবাক’ দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। যে ‘কোহিনূর’ নিজেদের বলে এতোদিন দাবি করে আসছিলো ভারতবর্ষ, সেই তারাই কিনা বলছে, রত্নটির মালিক বৃটেন।
সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থে করা মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে ‘হকের ধন’ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে এমন ‘অনাগ্রহে’র কথা জানান সলিসিটর জেনারেল রণজিৎ কুমার। অথচ ভারত সরকারই ২০১০ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সফরকালেও হীরকখণ্ডটি ফেরতের বিষয়ে দাবি তুলেছিলো।
তিনি বলেন, ‘ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মনে করছে, কোহিনূর ফেরত আনার চেষ্টা করা ঠিক নয়। কারণ, ওই হীরা চুরি করে বৃটেনে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কেউ তা জোর করে ছিনিয়েও নেয়নি। ব্রিটিশদের এটি উপহার দেওয়া হয়েছিলো। ’
সোমবার (১৯ এপ্রিল) শুনানিতে ইংল্যান্ডের রানির মুকুট থেকে ‘কোহিনূর’ ফেরানো নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন আদালত। কিন্তু সলিসিটর জেনারেলের মুখে এ ‘অনীহা’র কথা শুনে যেনো তাজ্জব বনে গেলেন সুপ্রিম কোর্ট।
অবাক হয়ে প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর সলিসিটর জেনারেল রণজিৎ কুমারকে সতর্ক করে দিয়ে জানতে চান, ‘যা বলছেন, তার অর্থ বুঝতে পারছেন তো! ভবিষ্যতে কোহিনূর নিয়ে আইনি পথে দাবি জানাতে কিন্তু সমস্যা হবে! তখন ওরাই (ব্রিটেন) বলবে, আপনাদের দেশের আদালতই তো কোহিনূর ফেরানোর আর্জি খারিজ করে দিয়েছে। ’
সর্বোচ্চ আদালত যে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলাটি খারিজ করে দিতে আগ্রহী নয়, তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন আদালত।
সলিসিটর জেনারেলের প্রতি প্রশ্ন রেখে বিচারপতি টি এস ঠাকুর করেন, ‘সবাই বলছে, কোহিনূর তাদের, কতোগুলো এমন দেশ রয়েছে জানেন? ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এমনকী, দক্ষিণ আফ্রিকাও। আপনারা জানেন এসব?
তবে ‘এসব জানেন না’ বলে আদালতকে জানিয়েছেন সলিসিটর জেনারেল। তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে কথা বলে অবস্থান পরে জানানো হবে।
ওইদিনের শুনানি শেষে আগামী ৬ সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যাই বলুক না কেন, মূল্যবান এ সম্পদ ফেরানোর ব্যাপারে কূটনৈতিক চেষ্টা চালাতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই। তবে এ বিষয়ে এখনও কিছু জানায়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রী মহেশ শর্মা বলেন, বিষয়টি স্বাধীনতার আগের। তাই কেন্দ্রীয় সরকারই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে আদালতের কোহিনূর নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের বক্তব্যের পর দেশটিতে নানা আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, ভারতবর্ষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ‘কোহিনূর’ নিয়ে সরকারের বক্তব্যে জাতি হতাশ। ‘যা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তা ফেরত আনতে সরকারের এতো গড়িমসি কেন?’
তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ব্রিটিশ আমলে পাঞ্জাবের তৎকালীন মহারাজা রণজিৎ সিং আফগান শাসকদের থেকে ‘কোহিনূর’ লাভ করেন।
যা পরে ভারতের একটি মন্দিরকে উইল করে যান তিনি। কিন্তু তার উত্তরসূরী দিলীপ সিং ১৮৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে মহামূল্যবান এই হীরকখণ্ডটি তুলে দেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৮৫০ সালের দিকে রাজা রণজিৎ সিংয়ের ছেলে দিলীপ সিং ছিলেন নাবালক। দ্বিতীয় ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধের পর শিখদের হারিয়ে শিখ সাম্রাজ্য দখল করে ইংরেজ।
এ নিয়ে লাহোরে একটি চুক্তি করেন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি। চুক্তি অনুযায়ী, মূল্যবান কোহিনূরসহ শিখ রাজার সব সম্পত্তি ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে সমর্পণের কথা বলা হয়। ফলশ্রুতিতে ‘কোহিনূর’ চলে যায় বৃটেনে।
কোহিনূর শব্দের অর্থ ‘আলোর পর্বত’। কোহিনূর সম্পর্কে সবচেয়ে পুরানো ঐতিহাসিক সূত্র পাওয়া যায় মুঘল সম্রাট বাবরের লেখা ‘বাবরনামাতে’।
সর্বপ্রথম ১৮৬.১০ ক্যারেট ওজনের কোহিনূর এক আশ্চর্য হীরকখণ্ড। তবে ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে বেশ কয়েকবার কাটার পর বর্তমানে এটির ওজন দাঁড়িয়েছে ১০৮ ক্যারেটে।
১৮৫১ সালে কোহিনূরকে কেটে বসানো হয় একটি আর্মলেটে। তখন কোহিনূর হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় বস্তু। এরপর ১৮৫২ সালে কোহিনূরের উপর আবারো ছুরি চলে। তখন ১৮৬.১০ ক্যারেটের হীরাটির ৪০ শতাংশই কাটা পড়ে। আকার ও ওজন কমে আসে ১০৮ ক্যারেটে।
ইতিহাস বলে, গত ৭০০ বছর ধরে কোহিনূরের মালিকানা একের পর এক বদলেছে বহুবার। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে অন্ধ্র প্রদেশের কোল্লুর খনি থেকে আবিষ্কারের পর এটি ছিলো কাকতীয় সাম্রাজ্যের শাসকদের হাতে। এরপর খিলজিদের থেকে এটি পায় মুঘলরা। শাহজাহানের ময়ূর-সিংহাসনে শোভা পেত কোহিনূর।
পরে নাদির শাহ দিল্লি লুণ্ঠন করে ময়ূর-সিংহাসনের সঙ্গে কোহিনূরও নিয়ে যান। তার সাম্রাজ্যের পতনের পর হীরকখণ্ডটি দখল করে আফগানরা।
এরপর শিখসহ অন্যান্যদের হাত ঘুরে বর্তমানে তা স্থির হয়েছে ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার মুকুটে।
বৃটেনে কোহিনূরকে প্রথমে রানি ভিক্টোরিয়া পরতেন তার হাতে। সেখান থেকে ১৮৫৩ সালে কোহিনূর স্থান করে নেয় তার শিরমূলে।
১৯১১ সালে রানি মেরির স্বর্ণমুকুট আলোকিত করে কোহিনূর। ১৯৩৭ সালে ষষ্ঠ জর্জের শপথের দিন রানিমাতার মুকুটে স্থান পায় সর্বকালের সেরা হীরকখণ্ডটি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৬
এমএ/আরআই