ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

সমাজের একঘরে থেকে দেশের ‘পদ্মশ্রী’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৯
সমাজের একঘরে থেকে দেশের ‘পদ্মশ্রী’ ১০৬ বছর বয়সী গাছের মা থিম্মাক্কা। ছবি: সংগৃহীত

বিবাহিত জীবনের ২৫ বছর হলেও কোনো সন্তানাদি হয়নি তার। এজন্য তাকে একঘরে করেও রেখেছে সমাজ। ‘গর্ভধারণ করতে না পারলে, নারী পূর্ণতা পান না’ এমন ধারণা থেকেই কর্ণাটকের থিম্মাক্কার সঙ্গে বর্বর আচরণ করেছিলেন সেদিনের পড়শিরা। 

কিন্তু দমে যাননি এই সংগ্রামী নারী। দিনযাপনের দুঃখগুলোকে শক্তিতে রূপান্তর করে সমাজের মান্দাতা আমলের কুসংস্কার দূর করে মধুর প্রতিশোধ নিলেন তিনি।

 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, ‘কন্নড়িগাদের দেশ’ দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের রাজ্য কর্নাটকের গুব্বি তালুকের বাসিন্দা থিম্মাক্কা। একই এলাকার বেকাল চিক্কাইয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা।  

কিন্তু দীর্ঘ সংসার জীবনে তাদের কোনো ছেলে-পুলে হয়নি। এ নিয়ে পড়শিদের অনেক কটু কথার মুখোমুখি হতে হয় তাদের।  

এমনকি সন্তান না হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীকে একঘরে করে দেয় তাদের সমাজ। তবে মানুষের এই ‘নির্মম শাস্তি’র মধুর জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা।  

ঠিক করলেন- গাছ লাগাবেন। আর এসব গাছকেই সন্তান স্নেহে যত্ন-আত্তি করবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। তবে থিম্মাক্কার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই, নেই পড়াশোনাও।  

তাই গ্রামের আর দশজন দরিদ্র নারীর মতোই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে  রুটিরুজি জোগাড়ের পাশাপাশি গাছ লাগান থিম্মাক্কা ও তার স্বামী।  

আর একাজ করতে গিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর হাসিঠাট্টারও পাত্র হয়েছেন তারা। ভূমিহীন এই দম্পতির কোনো সম্পদ ছিলো না।  কথা বলার সময় তার স্বামী একটু তোতলাতেন। এজন্য হাসির সুরে অনেকে তাকে ‘তোতলা চিক্কাইয়া’ বলেও বিদ্রুপ করতো।  

১০৬ বছর বয়সী গাছের মা থিম্মাক্কা।  ছবি: সংগৃহীত এসব ঘটনায় সমাজ বিচ্ছিন্ন লাজুক চিক্কাইয়া ও থিম্মাক্কার দিনগুলো ছিলো বেশ একলা, বিষণ্ণ। এরপরও তারা থেমে থাকেননি।   

গাছ লাগানো অভিযানের শুরুর বিষয়ে থিম্মাকা জানালেন, প্রথম বছরে তারা ১০টি, দ্বিতীয় বছরে ১৫টি, তৃতীয় বছরে ২০টি বটগাছের চারা লাগান। এক সময় এই ‘সন্তান’দের দেখাশোনার জন্য দিনমজুরির কাজও ছেড়ে দেন চিক্কাইয়া।  

থিম্মাক্কা রোজগার করতেন, আর বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে ‘সন্তানতুল্য’ গাছের যত্ন-আত্তি করতেন।  প্রতিদিনই প্রায় চার কিলোমিটার হেঁটে এসব গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার কাজ করতেন তারা।  

গবাদি পশুর হাত থেকে চারাগাছগুলোকে বাঁচাতে কাঁটাতারের বেড়াও বানিয়ে দেন নিজেদের উপার্জিত টাকায়। থিম্মাক্কা তার নিজের গ্রাম হুলিকাল থেকে কুদুর পর্যন্ত  ২৮৪টি বটগাছের চারা লাগিয়েছেন।  

থিম্মাক্কার সুন্দর সময়ের এই নিদর্শন দেখে যেতে পারেননি তার স্বামী চিক্কাইয়া। ১৯৯১ সালে তিনি মারা যান।  

তিনি একাই গাছগুলোর পরিচর্যা করতে থাকেন। এসব গাছ এখন বেশ বড় হয়েছে। স্থানীয় পথচারীরা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, থিম্মাকা নিজে না খেয়ে প্রায় চার কিলোমিটার সড়কজুড়ে গাছ লাগিয়েছেন। দাঁড়িয়ে থাকা এসব ছায়াময় সুবিশাল বটগাছগুলো থিম্মাক্কার ভালোবাসারই নিদর্শন।  

এখন পড়শিরা আর তাকে দেখে তাড়িয়ে দেয় না। কাছে ডেকে বসায়-দু’চারটি গল্পও করে। তাকে সম্মান দিয়ে ‘সালুমারাদা’ বলেও ডাকে স্থানীয়রা। কন্নড় ভাষার ‘সালুমারাদা’ মানে ‘গাছেদের সারি। ’

১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় নাগরিক সম্মানে’ ভূষিত করে রাজ্য সরকার। মূলত এরপরই তার কৃতকর্মের কথা ছড়িয়ে পড়ে ভারত তথা বিশ্বজুড়ে।  

বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাও এগিয়ে আসে তার সগযোগিতায়। বর্তমানে থিম্মাক্কার গাছগুলোর দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে কর্নাটক সরকার।  

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সন্তানদের নিজে প্রতিপালন করতে পারলেই আমি খুশি। কারণ কখনওই কারো সাহায্য চাইনি আমরা। ’ 

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি জানায়, গত ৮০ বছরে প্রায় ৮ হাজার গাছ লাগিয়ে বড় করে তুলেছেন ১০৬ বছর বয়সী থিম্মাক্কা। পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নে অবদান রাখায় এবছর থিম্মাকাকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করেছে ভারত সরকার।  

বাংলাদেশ সময়: ২০১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৯
এমএ/ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।