ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

১৩ বছর বয়সে আটক, এখন এ কিশোরের মৃত্যুদণ্ড চায় সৌদি!

হুসাইন আজাদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১১ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১৯
১৩ বছর বয়সে আটক, এখন এ কিশোরের মৃত্যুদণ্ড চায় সৌদি!

সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলের এক ধুলোমলিন রাস্তায় বাইসাইকেলে জড়ো হয়েছে একদল বালক। সাইকেলের পেডেলে পা রেখে প্রায় ৩০ জন বালকের ওই দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল ১০ বছর বয়সী মুর্তাজা কুরেইরিস। মনে হচ্ছিল কোনো প্রতিযোগিতা করার জন্য জড়ো হয়েছে বালকের দল। কিন্তু না, ওদের উচ্চকিত কণ্ঠে শোনা গেলো মানবাধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান।

২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’র উত্তাল সময়ে সৌদি রাজতন্ত্রের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র দাবিতে সেসময় দেশজুড়ে যে গণবিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল, তার অংশ হিসেবেই মুর্তাজা কুরেইরিস তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে সাইকেল রাইডে নেমেছিল। এই অল্পবয়সী বালকদের জড়ো হওয়ার বিষয়টি সেসময় ‘পর্যবেক্ষণ’ করে সৌদি সরকার।

 

ওই বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে তিন বছর পর মুর্তাজাকে ১৩ বছর বয়সে গ্রেফতার করে রাজতন্ত্রের বাহিনী। পরিবারের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ বাহরাইনে চলে যাওয়ার সময় সীমান্তে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সৌদি আরবের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসেবে মুর্তাজাকে নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে।

প্রায় চার বছর ‘বিচার-পূর্ব কারাভোগ’ করানোর পর এখন মুর্তাজাকে (১৮) মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে চায় সৌদি আরব সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মুর্তাজাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে সরকারের ‘সর্বাত্মক আয়োজন’ উঠে এসেছে।  

সিএনএন বলছে, সৌদি আরবে অপরাধের দায় দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমার বিষয়টি অস্পষ্ট হলেও সেখানকার রাজতন্ত্র আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সংগঠন কমিটি অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ডকে ২০০৬ সালে জানায়, তারা এ বয়সসীমা ১২ বছর মেনে থাকে। এমনকি দায় দেওয়ার বয়সের আগে কেউ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে সাজা দেওয়া হয় না বলেও দাবি করে রাজতন্ত্রের কর্তৃপক্ষ।

অথচ মুর্তাজার বিরুদ্ধে যে অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে, সে অনুসারে ‘অপরাধ সংঘঠিত করার সময়’ তার বয়স ছিল ১০ বছর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মুর্তাজার ভাই আলী কুরেইরিস মোটরসাইকেলেযোগে পূর্বাঞ্চলীয় শহর আওয়ামিয়াতে গিয়ে থানায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করেন, সেসময় তার সঙ্গে ছিল মুর্তাজাও।

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুর্তাজার এখন সন্ত্রাস আদালতে বিচার চলছে। মৃত্যুদণ্ড চেয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে মুর্তাজার ১৮ বছর বয়সে পদার্পণের কয়েক মাস আগে। তার বিরুদ্ধে ‘উগ্রবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত’ থাকার অভিযোগ এনেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এমনকি বিক্ষোভের সময় সহিংসতা, নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর পেট্রোল বোমা হামলায় সহযোগিতা, ভাইয়ের জানাজার সময় (বিক্ষোভকালে আলী কুরেইরিস নিহত হন) পদযাত্রা বের করার অভিযোগও আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রপক্ষ এসব অভিযোগের ব্যাপারে মুর্তাজার কথিত ‘স্বীকারোক্তি’ হাজির করলেও অধিকারকর্মী ও স্বজনরা বলছেন, হুমকি-ধামকি দিয়ে, নির্যাতন করেই এ জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে মন্তব্য নিতে সিএনএন যোগাযোগ করলেও সৌদি রাজতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি।

গত এপ্রিলে সৌদি আরব প্রায় ৩৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, মৃত্যুদণ্ড যাদের কার্যকর হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিয়া সম্প্রদায়ের। সুন্নি সম্প্রদায়পন্থি সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শিয়া দমন-পীড়নের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাছাড়া, সৌদির নিরাপত্তা বাহিনী বরাবরই শিয়া অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলের বিক্ষোভকে ‘সহিংসতা’ হিসেবে দেখে আসছে। মুর্তাজাকে মৃত্যুদণ্ডিত করার ‘আয়োজন’ বিষয়ে জানেন বয়োবৃদ্ধ বাদশাহ সালমান এবং তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানসিএনএন বলছে, পূর্বাঞ্চলে ওই বিক্ষোভকালে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বড়ভাই আলী নিহত হওয়ার সময় মুর্তাজার বয়স ছিল ১১ বছর। সংবাদমাধ্যমটির হাতে যে ভিডিওচিত্র এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, আলীর জানাজা ও দাফনের সময় বিক্ষুব্ধ-শোকাহত স্বজনরা রাজতন্ত্রবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিলেন। সেসময় আলী ও মুর্তাজার বাবা আবদুল্লাহ কুরেইরিস চিৎকার করে সৃষ্টিকর্তার কাছে তার পুত্র (আলী) হত্যার বিচার দাবি করেন।

যদিও মুর্তাজার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো ‘প্রাণহানির দায়’ এনে অভিযোগ জমা দিতে পারেনি, তবু তারা সবচেয়ে নির্মম সাজাই চাইছে এই কিশোরের। মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলে মুর্তাজার শিরশ্ছেদ পর্যন্ত করতে পারে রাজতন্ত্রের কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য, ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ কারণে শরিয়া আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজাই হতে পারে মুর্তাজার।

নির্বিচারে কারাবন্দীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের একটি সংস্থা ২০১৬ সালে মুর্তাজার নাম প্রকাশ না করলেও জানায়, এক অপ্রাপ্তবয়স্ক বন্দীকে নির্যাতন করে জোর করে ‘জবানবন্দি’ নেওয়া হয়েছে। তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল ‘নির্বিচারে’। তাকে যে কায়দায় বন্দী করা হয়েছে, সেটা আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানের লঙ্ঘন। অপ্রাপ্তবয়স্ক ওই বন্দীকে আটক করা হয়েছিল একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে।  

জাতিসংঘের সংস্থাটির উল্লিখিত ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক বন্দী যে মুর্তাজাই ছিল, সেটা তাদের নথির সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত হয়েছে সিএনএন। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওই সংস্থাটির সঙ্গে সিএনএন যোগাযোগ করলেও সাড়া মেলেনি।

স্থানীয় অধিকারকর্মীদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম বলছে, মুর্তাজাই কেবল বন্দী নয়, রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় তার বাবা এবং তার আরেক ভাইকেও কারাবন্দী করা হয়েছে গত বছর।

মুর্তাজার বিরুদ্ধে রাজতন্ত্রের ‘আয়োজন’ বিষয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত আরব মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ দামান জানান, তিনি নিজেও ২০১১ সালে মুর্তাজার সঙ্গে সেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, সেটি ছিল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। রাষ্ট্রপক্ষ এতো বড় শাস্তি চাইলেও মুর্তাজার বিরুদ্ধে সহিংসতার কোনো ভিডিও বা চিত্র হাজির করতে পারেনি।  

এখন সৌদি আরব যদি মুর্তাজাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে, তবে সেও সবচেয়ে কমবয়সে ‘অপরাধের দায়’ নিয়ে দণ্ডিতদের তালিকায় চলে যাবে। গত এপ্রিলে সৌদিতে যে ৩৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন ছিল এমন, যাদের সবচেয়ে কম বয়সে ‘অপরাধের দায়’ নিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। ওই তিনজনও গ্রেফতার হয়েছিল আরব বসন্তের সময় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ সহিংসতার দায়ে।

সিএনএন বলছে, সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যতবারই গণতন্ত্রকামীদের বিক্ষোভ হয়েছে, ততবারই তাদের ওপর নির্মম কায়দায় বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। আরব বসন্তের সময়কার সেই বিক্ষোভও ‘সর্বাত্মক অভিযানে’ দমন করা হয়েছে।

রাজতন্ত্রের আইন অনুযায়ী, সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে থাকে কেবল বাদশাহ সালমান আল সৌদ বা তার অনুমোদিত প্রতিনিধির আদেশক্রমেই। বাদশাহর ছেলে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে এক্ষেত্রে তার ‘ডেপুটি’ হিসেবে দেখা হয়। স্বভাবতই মনে করা হচ্ছে, মুর্তাজার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ‘আয়োজন’ বিষয়ে অবগত বয়োবৃদ্ধ বাদশাহ সালমান এবং তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানও।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌদি আরবে ভিন্নমতালম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন বেড়ে গেছে ২০১৫ সাল থেকে। বাদশাহ সালমান সিংহাসনে আরোহণের পর ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করে আরও কিছু প্রভাবশালী পদে অধিষ্ঠিত করলে এই দমন-পীড়নের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এমনকি মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘আধিপত্যবাদী’ মানসিকতাই সৌদিকে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে নির্বিচারে বেসামরিক নাগরিক হত্যার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৩ ঘণ্টা, জুন ০৭, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।