আর্থিক, কূটনৈতিকসহ সম্ভাব্য কী কী কারণে শিনজো আবে এই মুহূর্তে চীনের কাছ থেকে সরে আসার ব্যাপারটি বিবেচনা করছেন, এ বিষয়ে কথা বলতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডিপ্লম্যাট- এর লেখক মারসি কুয়ো সম্প্রতি জনস হপকিন্স-নানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চায়নিজ অ্যান্ড আমেরিকান স্টাডিজ সেন্টারের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক আবাসিক অধ্যাপক ড. ডেভিড আরাসের মুখোমুখি হন। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
মারসি কুয়ো: চীনে জাপানি কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন বন্ধ করতে তাগাদা দিচ্ছেন শিনজো আবে। এ বাবদ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে টোকিও ২.২ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই পদক্ষেপের পেছনে তাদের কী যুক্তি কাজ করছে বলে আপনি মনে করেন?
ডেভিড আরাসে: পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনের প্রতি জাপানের নির্ভরতা কমাতে চাওয়ার তাৎক্ষণিক দুটি কারণ রয়েছে। এক. অনেক জাপানি কোম্পানিই অতি গুরুত্বপূর্ণ নানা পণ্যের ব্যাপারে চীনের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল, তারা চীনের ওপর রীতিমত ‘বাজি ধরছে’। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়েছে, জাপানের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা এককভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল থাকা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ। এ পরিস্থিতি এই শিক্ষাই দেয় যে, জাপানি কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই চীনের ব্যাপারে একমুখীনতা কমাতে হবে, বিভিন্ন জায়গায় লগ্নি করে ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে এবং পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। বিশেষ করে জাপানের স্থিতি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে এমন অতি জরুরি পণ্যের ক্ষেত্রে।
কেবল চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতেই যে জাপান নিজেদের কোম্পানিগুলোকে ফিরে যেতে
বলছে, তা নয়। এর মধ্য দিয়ে মূলত এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। এসব কোম্পানি ফিরে গেলে যেমন জাতীয় স্থিতি ও নিরাপত্তা পোক্ত হয়, তেমনি দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানিগুলো এতে করে লাভবান হবে। আর এটি প্রাদেশিক পুনঃউন্নয়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে শিনজো আবের ক্ষমতাসীন এলডিপি সরকারকে রাজনৈতিকভাবেও লাভবান করবে।
মারসি কুয়ো: আপনার মতে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের এ সিদ্ধান্তের পেছনে কভিড-১৯ পরিস্থিতি কী ভূমিকা পালন করেছে?
ডেভিড আরাসে: করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি চীনের অন্তর্নিহিত ভাঙন তুলে ধরেছে। এ পরিস্থিতি দেশটির প্রশাসনের ওপর অন্যদের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে চীন থেকে যতোই দাবি করা হোক যে সেখানে করোনা নিয়ন্ত্রণে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশটিতে আবারও করোনার ধাক্কা লাগার আশঙ্কা রয়েছে। করোনার কবল থেকে বেরোতে চীনের নিদেন পক্ষে বছরখানেক লাগবে।
এছাড়া বিভিন্ন প্রণোদনা সত্ত্বেও, সারা বিশ্বেরই যেহেতু করোনা পরিস্থিতিতে উদ্ভূত আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে, সে ক্ষেত্রে সরকারি ও ব্যক্তিগত ঋণ বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি হ্রাস, রফতানি কমে যাওয়া, ঋণখেলাপি বেড়ে যাওয়া, সামাজিক অসন্তোষসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে আগামীতে চীনের ওপর নির্ভরতা নানাভাবে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি তৈরি করবে। এদিকে বর্তমানে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। আবার হংকং, তাইওয়ান প্রণালী, পূর্ব চীন সাগর ও দক্ষিণ
চীন সাগরেও বিতর্কিতভাবে প্রভাব বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে বেইজিং। সব মিলিয়ে জটিল এক রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হতে চলেছে চীনে।
সার্বিক প্রেক্ষাপটে আগামীতে আবারও চীনের ওপর নির্ভরশীল আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিপত্তির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি শিনজো আবেকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) ব্যাপারে খুব আগ্রহী বলে মনে হলেও, এই মুহূর্তে চীনের আলিঙ্গন থেকে পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া জাপানের কোনো পথ নেই।
মারসি কুয়ো: জাপানের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজারও চীন, এ প্রেক্ষাপটে শিনজো আবের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ কী ধরনের সমস্যা ও সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে?
ডেভিড আরাসে: জাপানের এ সিদ্ধান্তে চীন উদ্বিগ্ন বলেই মনে হয়। কেননা জাপানের লগ্নি প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত চীনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ মুহূর্তে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন পুনরুদ্ধারে চীনের ক্ষমতাসীন শি জিনপিং সরকারের পশ্চিমা অর্থনীতিতে প্রবেশ করা প্রয়োজন।
এদিকে চীন জাপান বা অন্যান্য দেশ থেকে সেই পণ্যগুলোই আমদানি করে যা সে নিজে উৎপাদন করতে পারে না। ফলে জাপানের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের জবাবে চীন তেমন কিছু করতে পারছে না। আর এই মুহূর্তে জাপানকে বড় কোনো শাস্তি দিয়ে টোকিও-বেইজিং সম্পর্ক নষ্ট করা বা সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার জন্ম দেওয়াও চীনের পক্ষে সম্ভব নয়।
তবে একটা ব্যাপার, চীন থেকে জাপানের এই বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে এভাবে অতিরঞ্জিত করে দেখা উচিত নয় যে, টোকিও বেইজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটা মূলত উদ্ভূত পরিস্থিতি ও নতুন বাস্তবতায় জাপানের ঝুঁকি হ্রাস ও সমন্বয় সাধন। চীনেরও উচিত হবে না এ বাস্তবতায় জাপানের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা।
মারসি কুয়ো: যদি বড় বড় জাপানি কোম্পানিগুলো চীনে নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, তাহলে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে টোকিও-বেইজিং সম্পর্ক কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
ডেভিড আরাসে: এর ফলে ভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে। চীনের বিআরআই প্রকল্পের মতনই মানসম্মত অবকাঠামো ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক’ (এফওআইপি) নামে জাপানেরও পরিমিত ও কার্যকর একটি কৌশল আছে। আবে তার সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে কোনোভাবে এফওআইপির সঙ্গে যুক্ত করবেন কিনা, বা করলে কোন মাত্রায় করবেন তার ওপর এই ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব নির্ভর করবে।
এফওআইপি প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক উন্নয়ন বজায় রাখা ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংহতি নিশ্চিতে কোয়াডভুক্ত (মূলত সমুদ্র অঞ্চলে চীনের বিতর্কিত প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে এ সংগঠন তৈরি করা হয়) দেশ ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চায় জাপান।
এখন চীন থেকে জাপানি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে শিনজো আবে যদি তা এফওআইপি কৌশলভুক্ত দেশগুলোতে খাটায়, সে ক্ষেত্রে এর অন্যরকম ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি হবে। কিন্তু জাপান যদি প্রকাশ্যে এমন উদ্যোগ নেয় তাহলে চীন অবশ্যই তাতে ক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে উঠবে। আর তা টোকিও-বেইজিং সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে। ফলে আগামীতে চীন-জাপান সম্পর্ককে খুব কুশলী হাতে নাড়াচাড়া করতে হবে।
মারসি কুয়ো: যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের অবনতির মধ্যে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের মধ্যে বৈদেশিক ও বাণিজ্য নীতি কেমন রূপ নিতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ডেভিড আরাসে: চীনের ওপর একক নির্ভরতা যে কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকেই সে শিক্ষা দিয়েছে। চীন কালক্রমে এ দুই দেশেরই অনেক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের একক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র দেখলো এই নির্ভরতা কতোটা ভয়ঙ্কর। মুহূর্তেই জরুরি এমন অনেক পণ্যের যোগান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দুই দেশই বুঝতে পেরেছে, খুব দ্রুত তাদের চীনের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান এফওআইপি প্রকল্পের কৌশলগত অংশীদার। আগেই এফওআইপি প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগ কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে সে ব্যাপারে বলেছি। চীনকে না ক্ষেপিয়ে জাপান-যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদারের সুযোগ অবশ্যই আছে। যদি দুই দেশের নেতারা নিজেদের সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি এজেন্ডার সমন্বয় করতে পারেন। যেমন, কৌশলগত ও আর্থিক বিবেচনায় ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদার হিসেবে ভারত জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পশ্চিমের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা যায়।
জাপান, যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের জন্যই নানাভাবে পরস্পরের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে তাদের এফওআইপি নিয়ে কীভাবে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করা যেতে পারে, তা ভাবতে হবে। নিজেদের সহযোগী, ব্যবসায়ী, অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় যেতে হবে। বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এডিবি, বিশ্ব ব্যাংক এদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। এভাবে তারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের বিকল্প হিসেবে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী হিসেবে উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশ খুঁজে বের করতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০২০
এইচজে/এজে