বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে মান্দারিন ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ করেছে চীনের উত্তরাঞ্চলের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী।
তিব্বতি ও উইগুর জাতিগোষ্ঠীর মতো মঙ্গোলীয়দেরও চীনের ‘মডেল সংখ্যালঘু’ জাতিতে পরিণত করার চীনা নীতিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ইনার মঙ্গোলিয়ার অধিবাসীরা।
চীন তার জাতিগত সংখ্যালঘুদের নির্মূল করতে অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে উইগুর মুসলমানদের ‘মূলধারায়’ অন্তর্ভুক্ত করার চলমান তৎপরতার মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত দেশটি এখন ইনার মঙ্গোলিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংখ্যালঘু মঙ্গোলীয়দের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে।
চলতি বছরের আগস্টে চীন সরকার ইনার মঙ্গোলিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একাডেমিক কারিক্যুলামের ওপর নজরদারি করার ঘোষণা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনের সঙ্গে সংযুক্ত অঞ্চলটিতে ৪২ লাখ মঙ্গোলীয়ের বসবাস। চীন সরকারের নতুন নিয়মের আওতায় অঞ্চলটিতে মঙ্গোলীয় ভাষায় শিক্ষাদান বন্ধ করে মান্দারিন ভাষায় সাহিত্য, রাজনীতি ও ইতিহাসের মতো বিষয় শেখানো হবে। তিব্বত ও উইগুর অধ্যুষিত জিনজিয়াংয়ে একই ধরনের কর্মসূচি চালাচ্ছে চীন সরকার, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি যাকে ‘সাংস্কৃতিক সম্পৃক্তকরণ’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
এমন নীতির পক্ষে যুক্তি দিয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি মঙ্গোলীয়দের উচ্চশিক্ষা ও চাকরি পেতে সুবিধা দেবে। এ ব্যাপারে চীনের মুখপাত্র হুয়া চুনইন বলেন, প্রচলিত জাতীয় কথ্য ও লিখিত ভাষা জাতির সার্বভৌমত্বের প্রতীক। জাতীয় ভাষা শেখা ও ব্যবহার করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য।
তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা চীনের এই দাবিকে চীনা প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিং গৃহীত ‘আগ্রাসী আত্তীকরণ’ নীতির একটি অংশ বলে জানিয়েছেন। ২০১৪ সালে শি জিনপিং বলেছিলেন, আমাদের কিছু অঞ্চলে দ্বিভাষিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা উচিত— সংখ্যালঘুদের জাতীয় সাধারণ ভাষা শেখা এবং ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মূলধারার জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুদের ভাষা শিখতে উত্সাহিত করার জন্য।
চীন সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইনার মঙ্গোলিয়ায় বসবাসকারী মঙ্গোলীয়রা গ্রহণ করেননি। ইনার মঙ্গোলিয়ার অধিবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী মঙ্গোলীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ করতে সফল হয়েছেন। পক্ষান্তরে রাশিয়ার প্রভাবে সিরিলিক বর্ণমালা ব্যবহার করছেন স্বাধীন মঙ্গোলীয়রা। ইনার মঙ্গোলিয়ার অধিবাসীরা নতুন চীনা নীতির বিষয়ে সেই একই ভয় পাচ্ছেন।
চীনের নতুন ভাষা নীতির প্রতিবাদে ইনার মঙ্গোলিয়ার ৩ লাখ শিক্ষার্থী নিয়ে ধর্মঘট করেন অভিভাবকরা। চলতি মাসে স্কুল চালু হওয়ার পর মাত্র ৪০ জন মঙ্গোলীয় শিক্ষার্থী পরবর্তী টার্মের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছে। প্রথম দিনের ক্লাসে মাত্র ১০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়। অভিভাবকরা আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ভাষা শিক্ষার নতুন নির্দেশনার পরিবর্তে তারা তাদের শিশুদের স্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতেই রাখবেন।
মঙ্গোলিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি সাখিয়াজিন এলবেগদর্জ টুইট করে বলেছেন, চীনে মাতৃভাষা ও ধর্মগ্রন্থ রক্ষায় সচেষ্ট মঙ্গোলীয়দের প্রতি আমাদের সমর্থন জানানো দরকার। মাতৃভাষা শেখা ও তা ব্যবহার করার অধিকার সবার অবিচ্ছেদ্য অধিকার। এই অধিকার সমুন্নত রাখাই চীনের সম্মানজনক ও দায়িত্বশীল শক্তি হয়ে ওঠার একটি উপায়।
ইনার মঙ্গোলিয়ার অভিভাবকদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে প্রদর্শিত একটি ব্যানারে লেখা ছিল, মঙ্গোলীয় হয়ে ওঠার অবিচ্ছেদ্য অংশ মঙ্গোলিয়ার ভাষা। যদি কোন ব্যক্তি তার ভাষা হারিয়ে ফেলে তবে সে তার জাতীয় পরিচয়ও হারিয়ে ফেলে।
মান্দারিন ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে একটি ভিডিওতে দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ার নাগরিকরা চিৎকার করে বলেন, ‘আমার মঙ্গোলিয়া! চিরকাল আমার মঙ্গোলিয়া!’ অন্য একটি ভিডিওতে অল্প বয়সী শিক্ষার্থীদের বলতে শোনা যায়, ‘মঙ্গোলিয়ান আমার মাতৃভাষা! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা মঙ্গোলীয়’।
খাদ্য বিতরণ কর্মীরাও মাতৃভাষার লড়াই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকে তাদের বাইকে ব্যানার বহন করেন, যাতে লেখা ছিল—আমাদের মাতৃভাষাকে বাঁচাও।
এক মঙ্গোলীয় কোয়ার্টজকে বলেন, আমরা আমাদের নিজ দেশেই সবচেয়ে দুর্বল ও নিপীড়িত। কল্পনা করে দেখুন, আপনার নিজের ভাষা শেখা ও পাবলিক ডকুমেন্টে নিজ ভাষায় স্বাক্ষর করার অনুমতি নেই!
প্রবাসী মঙ্গোলীয়, মানবাধিকার সংগঠন এবং স্থানীয়রা চীন সরকারের নতুন নীতি বাতিলের দাবিতে পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০টি কাউন্টারে ২০ হাজার লোকের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে এবং ১৯৬টি আবেদন আঞ্চলিক সরকারের শিক্ষা ব্যুরোতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মঙ্গোলীয়দের ভাষা শিক্ষায় চীন সরকারের আগ্রাসী নীতির প্রতিবাদে বাচ্চাদের স্কুলে না পাঠানোর জেরে প্রতিবাদকারী বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের কোনরকম শাস্তি দেওয়া হলে রাষ্ট্রায়ত্ত মঙ্গোলিয়ান টিভি ও রেডিও স্টেশনের প্রায় ৩০০ কর্মচারী বিক্ষোভে সংহতি জানিয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
চীনা সরকার কঠোরভাবে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছে। বিক্ষোভ কর্মসূচি নস্যাৎ করতে স্বায়ত্তশাসিত ওই অঞ্চলে সশস্ত্র সামরিক যানবাহন ও ট্যাঙ্ক মোতায়েন করে চীন সরকার।
গত ৩১ আগস্ট একটি ভিডিও শেয়ার করে ইউটিউবার জেনিফার জেং বলেন, চীন সরকারে ভাষা শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ চলাকালে ৩১ আগস্ট সামরিক সাঁজোয়া যান ইনার মঙ্গোলিয়ার রাস্তায় মোতায়েন করা হয়।
অন্যদিকে, পুলিশ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করে এবং সরকারি কর্মচারীদের তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে নির্দেশ দেয়; না হলে চাকরি হারাতে হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
চীনা কমিউনিস্ট সরকার মাতৃভাষার আন্দোলনের নেতাদের তালিকা প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দিলে প্রণোদনা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। বেশ কয়েকটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিও করা হয়েছে। হরকিন জেলায় এরকম একটি তালিকায় ১২৯ জন ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মঙ্গোলীয় বিক্ষোভকারীদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ও সংগঠিত হওয়ায় বাধা দিতে চীন সরকার ‘বাইনু’ নামে একটি মঙ্গোলিয়ান সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মও বন্ধ করে দিয়েছে।
চীন সরকার জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার দখল এবং তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ধ্বংস করতে কোন বদ্ধপরিকর। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত চীনা প্রশাসন দেশটির সংখালঘুদের জন্য আগ্রাসী ‘জাতিগত আত্তীকরণ’ নীতি অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইনার মঙ্গোলিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জনগোষ্ঠীর লোককে বসতি স্থাপন এবং মঙ্গোলীয় নারীদের বিয়ে করলে বিশেষ প্রণোদনা দিচ্ছে চীন সরকার। মঙ্গোলীয়দের ওপর মান্দারিন ভাষা চাপিয়ে দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বিলোপের নতুন পদক্ষেপ নিয়ে কর্তৃত্বপরায়ন দেশটি।
নব্বইয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে মান্দারিন ভাষাকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিতে থাকে চীন সরকার। আগে ইনার মঙ্গোলিয়ার স্কুলগুলোতে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হতো মান্দারিন ভাষা, পরে তা দ্বিতীয় শ্রেণিতে সংযুক্ত করা হয়েছে। এখন চীন প্রথম শ্রেণি থেকেই অর্থাৎ সবেমাত্র মাতৃভাষা বলতে ও লিখতে শেখা শিশুদের কণ্ঠেও মান্দারিন ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। চীন সরকারের আগ্রাসী এই নীতি বাস্তবায়নে আঞ্চলিক সরকার শিক্ষকদের সরকারি নীতিকে সক্রিয়ভাবে প্রচার এবং শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০
এমজেএফ