ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

অস্ত্রশক্তিই ভরসা শির, চীনে বিদেশি সাংবাদিকদেরও হেনস্তা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২০
অস্ত্রশক্তিই ভরসা শির, চীনে বিদেশি সাংবাদিকদেরও হেনস্তা

বিন্দুমাত্র স্বস্তিতে নেই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতার আঁচ পাচ্ছেন তিনি।

মানুষ ক্ষুব্ধ তাঁর একনায়কতন্ত্রে। তাই কিছুটা নার্ভাসও প্রেসিডেন্ট। পিপলস লিবারেশন আর্মি বা চীনের লালফৌজের কর্মকাণ্ডেও তিনি নাকি খুশি নন। কর্তৃত্ব ধরে রাখতে তিনি তাই আরো বেশি সামরিক ক্ষমতা দখল করতে চলেছেন। চালাচ্ছেন অস্ত্রশক্তির আস্ফালন। স্বৈরতন্ত্রী চীনা প্রশাসক রাজনৈতিক উত্থান মোটেই বরদাস্ত করতে রাজি নন। বিশ্বাসী শুধু দমন আর পীড়নে। এমনটাই জানা গেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিকি এশিয়ান রিভিউর (এনএআর) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। চীনের অভ্যন্তরীণ খবর যাতে বাইরের দুনিয়ায় প্রকাশ হতে না পারে তার জন্য শি প্রশাসনের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। অস্ট্রেলীয় নারী সাংবাদিক এখনো জেলে বন্দি।

এমনিতেই সামরিক বাহিনীর প্রচুর ক্ষমতা ভোগ করেন শি। তিনিই সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান। মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো তাঁর হাতেই সামরিক ও অসামরিক সব ক্ষমতা। ২০১৬ সাল থেকেই সরাসরি ফৌজি ক্ষমতা ভোগ করতে শুরু করেছেন তিনি। সেনাকর্তাদের তাঁর প্রতি আরো বেশি অনুগত করতে চেয়েছেন শি। বারবার সেনা কাঠামোতে বদলও করা হয়েছে। মুখে বলেছিলেন। দুর্নীতি দমনই সেনা সংস্কারের মূল লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সামরিক শাসকদের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান প্রতিরোধই তাঁর প্রধান লক্ষ্য।  

এনএআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনা প্রেসিডেন্ট আরো বেশি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছেন সেনাবাহিনীকে। পিএলএকে নিজের হাতের মুঠোয় রেখে তিনি ভোগ করতে চান পুরো ক্ষমতা। এর জন্য পুলিশ বাহিনীকেও সেনা অনুগত করে তোলা হচ্ছে। আমেরিকা বা ভারতের মোকাবেলার পাশাপাশি তিয়েনআনমেন স্কয়ারের মতো দেশীয় বিদ্রোহ দমাতে এখন থেকেই গোটা বাহিনীর রাশ পুরোপুরি তিনি নিজের হাতে রাখতে চান। তাই সামরিক কর্মকাণ্ডেও তাঁকে দেখা যাচ্ছে সক্রিয় অংশ নিতে। দক্ষিণ চীন সাগরে ব্যালিস্টিক মিশাইল পরীক্ষা তাঁর প্রকৃত উদাহরণ। দেশের ভেতরেও নিজের হাতেই ক্ষমতার লাগাম রাখতে চান তিনি। এনএআবের বিশ্লেষণ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ভার এখন আর আমলাদের হাতে নেই। সেটাও সামলাচ্ছেন তাঁর অনুগত কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না বা সিসিপির নেতারা।  

সামরিক বাহিনীতে তাঁর কমান্ডাররাও বুঝে গেছেন, আনুগত্যে খামতি দেখালে চলবে না। শি যদি মনে করেন, কেউ তাঁর বিরোধিতা করছেন, তাহলেই নেমে আসবে দুর্নীতির অভিযোগ। সেনা কমান্ডারদের চাকরিচ্যুতিতে বেশি একটা সময় নেন না শি। সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য শাস্তিও। একনায়কতন্ত্র বলে কথা! 

শুধু সেনাবাহিনীতেই নয়, বেসমারিক প্রশাসনেও বিস্তর পরিবর্তন আনা হচ্ছে। জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকায় ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে রাখতে মরিয়া তিনি। মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারারও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। জনগণকে সঞ্চয়মুখী করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে, খাবার নষ্ট করার থেকে সঞ্চয় করা অনেক ভালো। আসলে এর পেছনেও রয়েছে ব্যাপক সেনা আধিপত্য বিস্তারের কর্মসূচি।  

সেনাবাহিনীর হাত ধরে জনগণের ওপর আরো শক্ত রাষ্ট্রকাঠামো চাপিয়ে দিতে চান তিনি। এনএআরের ইঙ্গিত, চীনা জনগণ এখন আরো বেশি সেনা সন্ত্রাসের শিকার। এনএআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার ৬৭তম জন্মদিনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন প্রেসিডেন্ট। তাঁর লাল ফৌজ যে নেকড়ের বিক্রমের বদলে ভারতীয় বাহিনীর সামনে ভেজা বেড়াল হয়ে যাবে, এটা কল্পনাতেও আসেনি। কিন্তু বাস্তবে সেটাই হয়েছে। লাদাখ সীমান্তে গত জুন মাসে ভারতীয় সেনারা খালি হাতেই পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন চীনা সেনাকে। উভয় পক্ষেরই বেশ কয়েকজন মারা যান। লাল ফৌজই নাকি বেশি মরেছে। কিন্তু হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করছে না চীন।  

এনএআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাদাখের অপ্রত্যাশিত ফলাফলে এবং ভারতীয় সেনার বীরবিক্রমে শি বেশ ক্ষুব্ধ। তাই তিনি তাঁর বাহিনীর শুদ্ধিকরণে মন দিচ্ছেন। সেনা কর্তারা ভারতীয় ফৌজকে হালকাভাবে নেওয়ার কুফল পেয়েছে লাদাখে। খোদ শি নিজেই নাকি এটা মনে করছেন। নিজের বাহিনীকে তিনি নেকড়ের সঙ্গে তুলনা করতেন, সেই বিশ্বাসেও টোল খাইয়েছেন ভারতীয় ফৌজরা। তাই এখন সেনা সংস্কারই ভরসা! 

এনএআরের মতে, শি ঘরে-বাইরে ভীষণ চাপে রয়েছেন। আর সেই চাপ কমাতেই তিনি চাইছেন নিজেকে সেনাশক্তিতে ভর করে আরো শক্তিমান করে তুলতে। ভারতীয় সীমান্ত বা দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ভয়ও বেড়েই চলেছে। সঙ্গে রয়েছে দেশের ভিতরেও বিরোধী শক্তির উত্থান। গদি বাঁচাতে তাই সামরিক শক্তিকেই আরো জাপটে ধরছেন চীনা রাষ্ট্রপ্রধান।  

এতকাল ধরে চীন প্রতিবেশী সীমান্তকে ধীরে ধীরে দখল করেই চলছিল। অপরের জায়গাকে নিজের জায়গা বলে দাবি করা বহুদিনের চেনা চীনা ছক। এখন শুরু হয়েছে প্রতিরোধ। ভারতসহ চীনের প্রতিবেশীরা ধরে ফেলেছে চীনা ষড়যন্ত্র।

কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দুনিয়ার বহু দেশই এখন চীনবিরোধী। আন্তর্জাতিক সমস্যার পাশাপাশি দেশেও বাড়ছে ক্ষোভ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইপোচ টাইমের মতে, মাও সেতুংয়ের মতোই এখন ক্ষোভ সামলাতে সমস্ত ক্ষমতা দখলে মরিয়া শির দলে ও সরকারে নিজের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে অবশ্য হিতে বিপরীতও হচ্ছে। উত্তরের ইনার মঙ্গোলিয়ায় গত সপ্তাহেই বিদ্রোহ দেখা দেয়। আচমকা ইনার মঙ্গোলিয়ায় বিদ্রোহ চীনা কমিউনিস্ট নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তর চীনের মতোলিয়ানদের অভিযোগ, বেইজিং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ হানতে চাইছে। শিনজিয়াং রাজ্যের উইঘুর মুসলিমদের মতো তাদের ওপরও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। কমিউনিস্টরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। তাই তারা বিদ্রোহী। এ ঘটনাও শি-কে সেনা ক্ষমতার লাগাম পুরোপুরি নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করছে। বুঝতে পারছেন, ঘরে-বাইরে ক্ষোভ বাড়ছে। ক্ষোভ দমাতে তাই সেনা শাসকদের মতো তিনিও সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে মরিয়া। তাই দেশের ভেতরকার খবর বাইরে যাতে না যায়, সেই চেষ্টা আরো শক্তপোক্তভাবে করা হচ্ছে।

জানা গেছে, চেং লি নামে অস্ট্রেলিয়ার এক নারী সাংবাদিককে ১৪ আগস্ট থেকে আটকে রাখা হয়েছে। সে নাকি চীনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। চেং ছিলেন চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের (সিজিটিএন) সংবাদ উপস্থাপক। শি প্রশাসনের অভিযোগ, এই নারী সাংবাদিক নাকি চীনের জাতীয় স্বার্থ নষ্ট করে- এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। চেং লির গ্রেপ্তারের খবর অবশ্য চীনা প্রশাসন বেমালুম চেপে গিয়েছিল। সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, চীনে কর্মরত দুই অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক দেশে ফেরার পরই প্রকাশ্যে এসেছে সাংবাদিক গ্রেপ্তারের খবর।  

গত ৮ সেপ্টেম্বর সিডনিতে ফিরে যান দুই সাংবাদিক। দুজনই চীনে কর্মরত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা এবিসির বিল ব্রাটেলস এবং গৃদ্য অস্ট্রেলিয়ান ফিন্যানশিয়াল রিভিউর (এএফআর) মাইক স্মিথকে অবশ্য এক রকম ফিরতে বাধ্য করে চীন। চীন ছাড়ার আগে দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বার্টেলস বিবিসিকে জানিয়েছে, চীনা পুলিশ তাঁর কাছে চেং সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছিল। এই দুই সাংবাদিককেও হেনস্তা করা হয় বলে অভিযোগ। অস্ট্রেলীয় দূতাবাস থেকে তাদের দেশে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। তারা সেইমতো প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু মাঝরাতে সাত-সাতজন চীনা পুলিশ তার ঘরে ঢুকে জুলুম করে বলে অভিযোগ করেছেন বিল। অস্ট্রেলীয় দূতাবাসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। সেখানেও তাঁকে জেরার মুখোমুখি হয়ে দেশে ফেরার অনুমতি পান।  

সাংবাদিকদের কাছে প্রকৃত সত্য লুকনো হচ্ছে। কোনো অবস্থায়ই মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই চীনে। বিদেশি সাংবাদিকরাও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন সমাজতান্ত্রিক চীনে। আসলে সাঁজোয়া বাহিনীর বলে বলীয়ান চীনা কমিউনিস্ট নেতারা মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকারকে লুণ্ঠন করে চলেছেন। মত প্রকাশের যেমন স্বাধীনতা সেখানে নেই, তেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার আড়ালে অবাধে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার সব রকম আয়োজন। সভ্যতার সেই আদিম যুগে পড়ে রয়েছে চীন। বন্দুকের নল আর শি জিনপিংয়ের একনায়কতন্ত্রই সেখানে শেষ কথা বলে। বিদেশি সাংবাদিকরাও তাই লাঞ্ছিত হন প্রতিনিয়ত। এখনো জেলবন্দি থাকতে হচ্ছে অস্ট্রেলীয় নারী সাংবাদিককে। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে বিরুদ্ধ মতামত দমনে তিয়েনআনমেন ফর্মুলায়ই বিশ্বাসী চীনা নেতৃত্ব। চাইছে অস্ত্রশক্তিবলে দাবিয়ে রাখতে মানবসভ্যতাকে। পশ্চিমা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমেও ধরা পড়ছে চীনের এই ভয়ংকর ছবি।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।