ভারতে প্রধানমন্ত্রী অনেকেই হয়েছেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির আমলটা পুরো অন্যরকম।
শ্রীনগরের বিখ্যাত ডাল লেকের পাশে বসে মহঃ ইউসুফ শোনালেন তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, ডাললেকের এই মায়াবি চেহারাই তো ভুলতে বসেছিলাম। গত এক বছরে অনেক শান্ত হয়েছে কাশ্মীর। এখানকার যুবকরা এখন ৫০০ টাকার জন্য ফৌজিদের পাথর ছুড়তে যাওয়ার বদলে চাকরির চেষ্টা শুরু করেছে।
কারা ছুড়তেন পাথর? ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ বলছে, পাকিস্তানিদের পয়সায় কিছু বেকার যুবক এই কাজে নিযুক্ত ছিল। ২০১৬ সালে ২ হাজার ৬৫৩টি পাথর বৃষ্টির ঘটনার সাক্ষী কাশ্মীরের মানুষ। অথচ গত বছর ৫ আগস্ট কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা লোপ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য গঠনের পর অশান্তি বন্ধ।
পুলওয়ামার গ্রামপ্রধান আলতাফ ঠাকুর বললেন, এখন কাজের মধ্যে এসেছে স্বচ্ছতা। সরকারের দায়বদ্ধতাও অনেক বেড়েছে। উন্নয়ন হচ্ছে। মানুষ খুশি।
পরিস্থিতির পরিবর্তন সাংবাদিকদের চোখেও ধরা পড়েছে। স্থানীয় সাংবাদিক তারিক ভাট বললেন, জন্মের পর থেকেই তো শুনে এসেছি হরতাল আর শুধু হরতালই। গত এক বছরে সেই বন্ধা রাজনীতির বদলে মানুষ এখন উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারছে। এটাই বড় প্রাপ্তি।
অতি সম্প্রতি মোদি সরকার কাশ্মীরের জন্য 'স্টার্স প্রকল্প' (Strengthening Teaching-Learning and Results for States (STARS) project) ঘোষণা করেছে। ৫২০ কোটি রুপির এই প্রকল্প রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করবে। ছেলেমেয়েদের করে তুলবে রোজগারমুখী। জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ কেন্দ্রীয় শাসিত রাজ্য দুটির মানুষদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি যুবকদের স্বাবলম্বী করে তুলবে স্টার্স। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই ট্যুইট করে বলেছেন, স্টার্স শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান বাড়াবে। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের জীবন সংগ্রাম আরও সহজতর হবে এরফলে।
যুবকদের কর্মমুখী করে তোলার পাশাপাশি মোদি সরকার খেলাধূলার উন্নয়নেও ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি ৪৯ কোটি ৭৮ কোটি টাকার ক্রীড়া পরিকাঠামোর উদ্বোধন করেছেন জম্মু-কাশ্মীরের উপ-রাজ্যপাল মনোজ সিনহা। একইসঙ্গে তিনি ১০ কোটি ৫০ লাখ রুপি খরচ করে আরও একটি ক্রীড়া পরিকাঠামোর শিলান্যাস করেন। শ্রীনগরে বহুদিন ধরেই ফুটবলার ও কোচদের দাবি ছিল একটি আধুনিক ফুটবল স্টেডিয়ামের। কাশ্মীরি ফুটবলাররা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুনামের সঙ্গে খেলে বেড়ালেও নিজেদের রাজ্যে তেমন পরিকাঠামো না থাকায় সমস্যায় পড়তেন। শ্রীনগরের জেলাশাসক শহিদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ২৫ কোটি রুপি খরচ করে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক ফুটবল স্টেডিয়াম। ফলে উঠতি ফুটবলাররাও খুশি।
আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য না নেওয়ায় ধুঁকছিল বিশ্ববন্দিত কাশ্মীরি সিল্ক। এক বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের উন্নয়নের দায়িত্ব সরাসরি কাঁদে তুলে নিতেই সেই সিল্পক শিল্পও আজ ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্বা জেলার বারি ব্রহ্ম এলাকায় রেশম শিল্পের বিকাশে আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়। এর জন্য প্রায় ২৫ কোটি রুপি খরচ করে ভারত সরকার। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চিত যোজনা বা এমজিএনরেগা প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থান আজ নিশ্চিত হয়েছে। গড়ে উঠছে একাধিক পরিকাঠামোও। রাজৌরিসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্রামের মানুষরাই গড়ে তুলছেন রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ফৌজি বাঙ্কারও। তাদের যেমন রোজগার হচ্ছে, তেমনি উন্নয়ন হচ্ছে পরিকাঠামোরও। আগে শুধু লুঠপাটই হতো গ্রামোন্নয়নের টাকা। এখন সেই টাকা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামবাসীদের হাতে। ৩৭০ ধারা বিলোপের আগে খাতায় কলমেই শুধু ছিলো পঞ্চায়েত রাজ। এখন সক্রিয় হয়েছে পঞ্চায়েত। গ্রামের মানুষ পাচ্ছেন স্বচ্ছ স্থানীয় প্রশাসন।
গত এক বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে কাশ্মীরে আপেলের উৎপাদন বেড়েছে অন্তত ৪০ শতাংশ. করোনা আবহাওয়াতেও জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখের সবচেয়ে অর্থকরী ফসলের গায়ে কোনও আঁচড় না লাগে সেদিকে সবসময়ই সজাগ ছিল প্রশাসন। উৎপাদনের পাশাপাশি আপেল রপ্তানিরও সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে ফলপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প। আপেলের উপযোগী পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের হাত ধরে চাষীরা পাচ্ছেন ন্যায্য দাম।
রাজনৈতিক স্বার্থে অনেকেই কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরোধিতা করছেন। স্বাভাবিক। কারণ তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ঘা লেগেছে। কিন্তু কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ মোদি-সরকারকে বাহবা দিচ্ছেন। কারণ তারা উপকৃত হয়েছেন। জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখের পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় দিকটি হলো ভারতীয় সংবিধান মেনে এখানকার বাসিন্দারা উন্নয়নের রাস্তাকে মন থেকে মেন নিয়েছেন। সরকারও দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতো অনগ্রসর শ্রেণিদের শিক্ষা, চাকরিতে সংরক্ষণ, সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। জমু কাশ্মীর এবং লাদাখের মানুষও পাচ্ছেন তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি (অত্যাচার প্রতিরোধ) আইন, ১৯৫৪, হুইসেল ব্লোয়ার্স প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ২০১৪, জাতীয় সাফাই করমচারিস আইন, জাতীয় জাতীয় প্রগতিশীল আইন, সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় কমিশন আইন এবং শিশুদের নিখরচায় ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯-এর মতো আইনের সুবিধাগুলি। এতোকাল তারা ছিলেন বঞ্চিত।
কাশ্মীরিরা বুঝেছেন, গত একবছরে তাদের জকল্যাণে বহু কাজ হয়েছে উপত্যকায়। স্থানীয় সরকারের ১০ হাজার চাকিরতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তফসিলী উপজাতি, ওবিসি এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর মানুষরা এখন পাচ্ছেন চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধা। ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পরই কাশ্মীর উঠে এসে উন্নয়নের মহাসড়কে। হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, পর্যটন কেন্দ্র, রাস্তা, জল নিকাশি ব্যবস্থার কাজ। প্রভৃতি চলছে যুদ্ধকালীন ততপরতায় পাহাড়ি দুর্গম এলাকায়ও পৌঁছে যাচ্ছে পানীয় জল, বৈদ্যুতিক সংযোগ। উন্নয়নের কারণেই জেগে উঠেছে ভারতীয়বোধ। স্থানীয় মানুষ আজ প্রাণ খুলে ওড়াচ্ছেন দেশের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা। কাশ্মীরে বসবাসকারী মুসলমান নারীপাও আজ খুশি। তিন তিলাকা নিয়ে মোদি সরকারের সিদ্ধান্ত তাদের আত্মমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। অশান্তির অবসান দিয়েছে জীবনের নিরাপত্তা। এখন রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাদ্যশস্য। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা লোপ এবং বর্তমান কর্মযজ্ঞ প্রসঙ্গে ভারতের দূরদর্শন ও আকাশবাণীর নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রসার ভারতীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান এ সূর্য প্রকাশ বলেন, “সাত দশক ধরে উপত্যকায় যে লজ্জাজনক, বৈষম্যমূলক এবং অগণতান্ত্রিক নীতি চলেছে তার অবসান হয়েছে। ”
উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে কাশ্মীরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগেই বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন এই দুই কেন্দ্রাশিত অঞ্চলের উন্নয়নে। তার বাইরেও উপ-রাজ্যপাল মনোজ সিনহা ঘোষণা করেছেন, ১ হাজার ৩৫ কোটি রুপির প্রশাসনিক প্যাকেজ। এছাড়াও কাশ্মীরের মানুষদের পাণীর বিল এবং বিদ্যুতের বিলে ছাড় দেওয়া হচ্ছে ৫০ শতাংশ। উপ-রাজ্যপালের প্রতিশ্রুতি, জম্মু-কাশ্মীরের জন্য ঘোষিত হবে নতুন শিল্পনীতি। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত স্ট্যাম্প ডিউটি মকুব করা হয়েছে। প্রশাসন ঠিক করেছে ব্যবসাক্ষেত্রে ঋণের সুদে ৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে ৬ মাস। এতে ব্যবসায়ীদের অনেকটাই লাভ হবে।
৩৭০ ধারা বিলোপের ফলে কাশ্মীরে ফিরে আসছে বহু কাঙ্খিত শান্তি। গত এক বছরে্ নাশকতারমূলক ঘটনা কমেছে ৫৪ শতাংশ। জঙ্গি হানায় নিরাপত্তা বাহিনীর মৃত্যুর হার কমেছে গত এক বছরে ৭৪ শতাংশ। সম্প্রতি ভারেতর জাতিয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি জানান, ৫ আগস্ট ২০১৯ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০২০-র এই ১৭৩ দিনের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ২২ জন জওয়ান। এর আগে ১৩ ফেবিরুয়ারি ২০১৯ থেকে ৪ আগস্ট ২০১৯-এর এই ১৭৩ দিন সময়ের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৮২ জন জওয়ান। এছাড়া ৫ অগস্ট ২০১৯-এর পর ৩২ জন সন্ত্রাসবাদী নিহত হয়েছে।
একদিকে সন্ত্রাস কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। ৩৭০ ধারা বিলোপ করে মোদি সরকার ফিরিয়ে দিয়েছেন কাশ্মীরি মানুষদের আত্মবিশ্বাস। আত্মনির্ভর হওয়ার ডাক দিয়ে ভূ-স্বর্গকে তার পুরনো ছন্দে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মরিয়া ভারত সরকার। আর তাই উন্নয়নকেই হাতিয়ার করে কাশ্মীরের মানুষের কাছেও পৌঁছে দিতে চাইছে কল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচির সুফল। অপপ্রচার চললেও কাশ্মীরের মানুষ সেটা বুঝেছেন। তাই আজ পাহাড় হাসছে। উড়ছে ভারতের ত্রিবর্ণ জাতিয় পতাকা। বহু দশক পর কাশ্মীর এখন পুরোপুরি ভারতের, কাশ্মীরিরাও নিজেদের মন থেকে ভারতীয় ভাবতে শুরু করেছেন।