কাশ্মীর নিয়ে আজও রয়েছে অনেক ভ্রান্ত ধারণা। সেই ভুল ধারণার মূল কারণ ইতিহাসের বিকৃতি।
উপত্যকার আজকের পরিণতির সূত্রপাতও সেই সময়ই তৈরি হয়। দেশভাগ নিয়ে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামীরা কেন এত হুটোপুটি করেছিলেন, সেটা নিয়েও অনেকের মনে সংশয় রয়েছে। দেশভাগ নিয়ে আরো চিন্তাভাবনার প্রয়োজন ছিল। অনেক প্রশ্নের জবাব আজও রহস্যজনক রয়ে গেছে।
ভারত কেন নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স পেল না? ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তো কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল? বেলুচিস্তানের ৮০ শতাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত কালাত। পাকিস্তানের বর্তমান মানচিত্রের ৪০ শতাংশ এলাকাই কালাতের মধ্যে পড়ে। কী করে পাকিস্তান ১৯৪৮-এর এপ্রিলে দখল করল? গিলগিটকাণ্ডও ভারতের বিরুদ্ধে একটা বড় ষড়যন্ত্র। বালতিস্তান, হুঞ্জা, নগর, পুনিয়াল, ইয়াশিন, ইস্কোমান ও চিত্রাল ভারতেরই দখলে থাকা উচিত ছিল। ভারতীয়রাও অনেকেই এ জায়গাগুলো সম্পর্কে অপরিচিত। কিন্তু এই জায়গাগুলোর গুরুত্ব অনেক।
বালতিস্তান, সাকহাম উপত্যকা, আকসাই চীন ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে (পিওকে) ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে দেখানো হলেও জম্মু ও কাশ্মীরের মানচিত্রে চিত্রালের কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু চিত্রাল কাশ্মীরের অধীনেই ছিল। অথচ চিত্রালকে পাকিস্তানের অঙ্গ হিসেবে দেখানো হলেও কেউ আপত্তি করেনি। কেন প্রতিবাদ করা হয়নি চিত্রাল নিয়ে? ১৮৭০ সালে অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধকালে ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে পরাস্ত করার বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তায় ছিল। আফগানিস্তান চিত্রালের মেহতারকে হুমকিবার্তা পাঠায়।
বলা হয়, ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে আফগান পক্ষ না নিলে চিত্রাল আক্রমণ করা হবে। তখন ব্রিটিশদের পরামর্শে মহারাজা চিত্রালের সঙ্গে সন্ধি করেন। কাশ্মীরের মহারাজার সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতেই ১৮৭৮ থেকে চিত্রাল কাশ্মীরের অঙ্গ। এই চুক্তি মতেই চিত্রালের মেহতার কাশ্মীরের মহারাজার নির্দেশ মানতে বাধ্য। মহারাজার শত্রুকে নিজের শত্রু বলে মানতেও বাধ্য ছিলেন তিনি। তাকে বার্ষিক নজরানাও দিতে হতো কাশ্মীরের মহারাজাকে। আবার বিনিময়ে কাশ্মীর থেকে ভর্তুকিও পেত চিত্রাল।
১৯৩৯-এ চিত্রালের মেহতার কাশ্মীর দরবারে ১৮৭৮-এর চুক্তি মতে সরাসরি আলোচনার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। সেই চুক্তিতে ব্রিটিশদের কোনো উল্লেখই ছিল না। অর্থাৎ কাশ্মীর নিয়ে ব্রিটিশদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। ১৯৩৫ সালে গিলগিট ওয়াজারাত অবশ্য ইংরেজশাসিত ভারত সরকারের হস্তগত হয়। এই সময়ই কাশ্মীরের সঙ্গে চিত্রালের চুক্তির বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের কারণে ফের ধামাচাপা পড়ে যায় চিত্রালের বিষয়টি। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ চিত্রালের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ক নিয়ে কাউকে ভাবার অবসরই দেয়নি। ফলে অমীমাংসিতই থেকে যায় বিষয়টি। এরই মধ্যে ১৯৪৭-এ ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং দেশভাগ। ব্রিটিশরা কিন্তু কখনোই কাশ্মীর বা চিত্রাল শাসন করতে পারেনি।
তাই সাতচল্লিশের অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহেই কাশ্মীর আক্রমণের পেছনে ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মহারাজার বাহিনী ব্রিটিশ সামরিক অফিসার মেজর উইলিয়াম আলেকজেন্ডার সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গিলগিট দখল করে সেখানে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেন। একইভাবে বালতিস্তানও পাকিস্তানের অঙ্গ হয়ে ওঠে। চিত্রাল কাশ্মীরের অঙ্গ হলেও তা নিয়ে ভারত কখনো মাথাব্যথা দেখায়নি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বালুচিস্তান ছাড়াও পাকিস্তানের বহু এলাকাই ভারতের হাতছাড়া হোক এটা ব্রিটিশরা চেয়েছিল। রহস্যজনক ভারতের ভূমিকা।
দেশভাগের ৭০ বছর পার হয়ে গেলেও পাকিস্তানের দখলদারি নিয়ে এতকাল কোনো উচ্চবাচ্য করতে শোানা যায়নি। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা কি মনে করেন, দেশভাগ সত্যি জরুরি ছিল? সাম্প্রদায়িকতাই দেশভাগকে বাধ্য করেছিল অনেকেরই এটাই বিশ্বাস। কিন্তু সেই ধারণা বদলের সময় এসেছে। গিলগিটের ঘটনা উদাহরণ মাত্র। পেছনে আরো রহস্য রয়েছে।
১৯৩৫ সালের ব্রিটিশ-ভারত গভর্নমেন্ট গিলগিট দখল করতে চেয়েছিল। কিন্তু করেনি। বলা ভালো করতে পারেনি। কারণ গিলগিট ছিল কাশ্মীরের মহারাজার অধীনে। তাই আইনবলেই ব্রিটিশরা সেটা করতে পারেনি। ১৯৩৫ সালের এই আইনবলেই প্রমাণিত হয়, গিলগিট কাশ্মীরের মহারাজার অধীনেই ছিল। তাই ব্রিটিশরা সেখানে নাক গলাতে পারেনি। নইলে এই আইন দিয়েই ব্রিটিশরা গিলগিট দখল করতে পারত। পারত হুঞ্জা, নগর, কো-গিজার, ইয়াশিন ও ইস্কোমানকে অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে যুক্ত করতে। পুনিয়ালও কাশ্মীরের দরবারে অংশ নিয়ে মহারাজার জায়গির গ্রহণ করে। কিন্তু অন্যায়ভাবে ব্রিটিশরা কাশ্মীরের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আঘাত করে। অথচ কাশ্মীরের জনগণনার রিপোর্টে আটটি প্রাদেশিক রাজ্যের কথাই উল্লেখ রয়েছে।
ব্রিটিশ ভারতের ১৯৩৫-এর আইন মতে কি চিত্রাল কাশ্মীরের অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত নয়? চিত্রাল কাশ্মীরের অধীনেই ছিল। ১৯১৪ সালের চুক্তিতেই তার উল্লেখ রয়েছে। আইচিসন চুক্তির ১১ খণ্ডের ৪২৮ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। চুক্তিপত্রটি প্রত্যয়ন করেছিলেন চিত্রালের সহকারী পলিটিক্যাল এজেন্ট। ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের সংজ্ঞা অনুযায়ীই চিত্রালকে কাশ্মীরের অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত ছিল। কিন্তু বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশরাই সেই আইনের সংশোধন করে।
নতুন সংশোধনীতে বলা হয়, সরাসরি শাসকের অধীন নয় এমন রাজ্যগুলোকে ভারত সরকার চাইলেই নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। অর্থাৎ কাশ্মীরের অধীন এলাকা দখলের ফন্দি ভালোই করেছিল ব্রিটিশরা। মহারাজার অধীন এলাকাগুলোকে তার হাত থেকে কেড়ে নিতেই ব্রিটিশদের এই চাতুরীর আশ্রয় নিতে হয়। চরম বিশ্বাসঘাতকতা! ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি সিন্ধুর পানি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। সেই সময় পাকিস্তানের দাখিল করা মানচিত্রে সাবেক গিলগিটকে পাকিস্তানের অঙ্গ হিসেবেই দেখানো হয়। সেই সময় ১৯৫৩ সালের ২১ মার্চ সেচ ও বিদ্যুত্ মন্ত্রক থেকে রাজ্য মন্ত্রকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল গিলগিটের তত্কালীন অবস্থানের কথা। ৩০ জুন জন্মু ও কাশ্মীরের মুখ্য সচিবের কাছ থেকে গিলগিট সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়। মুখ্য সচিব বিশ্বনাথন ২৯ জুলাই ভারত সরকারের যুগ্ম সচিবকে তার নোটস পাঠান। সেই নোটে গিলগিট এজেন্সির এলাকা সম্পর্কে চারটি জায়গার উল্লেখ করা হয়েছে-(১) গিলগিটের তহসিল ও আস্টরের নিয়াবত নিয়ে গিলগিট ওয়াজারাত। (২) হুঞ্জা ও নগর প্রদেশ। (৩) রিপাবলিক অব চিলা এবং (৪) পুনিয়াল, ইয়াশিন, কো-গিজার, ইস্কোমানের গভর্নরশিপ।
১৮৮০ থেকে ব্রিটিশরা মহারাজার শাসনাধীন কাশ্মীরকে উত্ত্যক্ত করার নানা ফন্দিফিকির করতে থাকে। কাশ্মীরের মহারাজার প্রতি সেই শত্রুতা ভারত ছাড়ার সময়ও যায়নি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পুরো গিলগিটটাই পাকিস্তানের তুলে দেওয়াটাও তাদের সেই মানসিকতারই অংশ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর নিয়ে ভারত সরকার একাধিক নির্দেশিকা পাঠায়। সেই নির্দেশিকা বিশ্লেষণ করলেও গিলগিট নিয়ে ব্রিটিশদের পাকিস্তান দরদের পরিচয় মেলে। খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও গিলগিট-বালতিস্তান নিয়ে বহু চিঠি রয়েছে। কিন্তু সেই চিঠিগুলোতে ভারতের বহু এলাকা পাকিস্তানের দখলে চলে যাওয়ার বিষয়টি অনুচ্চারিত।
ব্রিটিশরা প্রথম থেকেই কাশ্মীরের মহারাজার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। তারা চায়নি গিলগিট বা চিত্রাল তার অধীনেই থাকুক। ব্রিটিশরা চিরকালই তাই কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষেই সওয়াল করেছে। জনমতকে উপেক্ষা করে তারা চেয়েছিল গোটা জম্মু ও কাশ্মীরই থাকুক পাক-পদতলে। তাই কাশ্মীরের অঙ্গ হলেও গিলগিট পেয়েছে পাকিস্তান।
চিত্রালও তা-ই। রহস্যজনক ভারতীয় জননেতাদের নীরবতাও। চিত্রাল বা গিলগিট নিয়ে চাপ বৃদ্ধির বদলে তারা স্বাধীনতা ও দেশভাগের জন্য কেন এত হুটোপুটি করে দেশের অঙ্গহানি ঘটালেন সেটা আজও বোধগম্য নয়। ঐতিহাসিকরাও বেশির ভাগই ব্রিটিশদের মনগড়া বক্তব্যেই প্রভাবিত। তাই গিলগিট বা চিত্রালের ঘটনা সাধারণ মানুষের অগোচরেই রয়ে গেছে আজও। সময় এসেছে সেই ইতিহাসকে সত্যের আলোকে তুলে ধরার।