সেনাবাহিনীর অতি সক্রিয়তায় ক্ষোভে ফুঁসছে পাকিস্তান। অশান্তির আগুনে জ্বলছে সিন্ধ।
ঘটনার সূত্রপাত বহু আগে থেকেই। পাকিস্তান সেনাকর্তারা ইমরান খানকে তাঁদের হাতের পুতুল বানিয়ে সর্বত্রই বকলমে জারি করেছিলেন সামরিক শাসন। সিন্ধ প্রদেশ পুলিশের আইজিপি অপহরণ সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনা আইজিপি মুস্তাক মেহরকে তাঁর বাসগৃহ থেকে অপহরণের ঘটনা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। ক্ষমতা লোভী পাকিস্তানি সেনাকর্তারা চেয়েছিলেন, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করে আরো বেশি সেনা কর্তৃত্ব কায়েম করতে। সাবেক পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জামাই মহম্মদ সফদরকে আইজিপি অপহরণের আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। হোটেল থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় সেনা ছাউনিতে। নওয়াজের মেয়ে, পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) দলের সহসভানেত্রী মরিয়মকেও গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা ছিল সেনাকর্তাদের। দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে তাঁরা সিন্ধে গিয়েছিলেন। সিন্ধ সফরের শুরুতেই মহম্মদ আলী জিন্নাহর সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা জানান তাঁরা। পিএমএল (এন) নেতাদের বিরুদ্ধে জিন্নাহর সমাধিস্থলে স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ তুলে সেনাকর্তারা শুরু করেন তাঁদের দাদাগিরি। সেনাবাহিনীর হাতে ধৃত নওয়াজ শরিফের জামাই সফদর ব্লাড সুগারের রোগী। সেনা হেফাজতে তাঁকে ওষুধ পর্যন্ত খেতে দেওয়া হয়নি। করা হয়েছে অমানবিক অত্যাচার। আসলে গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে পাকিস্তানি সেনা। এর আগে সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করেছিল পিএমএল (এন)। সেই মিছিলে ব্যাপক ভিড় সেনাকর্তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। তাঁরা বুঝতে পারেন, পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই শুরু হয় আরো বেশি দমন-পীড়ন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মতোই নিজেদের সিন্ধ প্রদেশেও সেনা জুলুমের মাত্রা ছাড়িয়েছে। জনপ্রিয়তা যত কমছে পাকিস্তানি বাহিনীর, ততই ক্ষমতা আগলে রাখার স্বার্থে বাড়াচ্ছে জুলুমের মাত্রা।
এই ঘটনার প্রতিবাদে সিন্ধ পুলিশের সব অফিসার ছুটিতে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। শুরু হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে সিন্ধ। শোনা যাচ্ছে, সেনা-পুলিশ সংঘর্ষে অন্তত ১০ পুলিশকর্মী করাচি শহরে প্রাণ হারিয়েছেন। গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কিছুটা হলেও পিছু হঠতে বাধ্য হন সেনাকর্তারা। সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়া আইজিপি অপহরণ কাণ্ডে দুঃখ প্রকাশ করে তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর অবশ্য পুলিশি বিদ্রোহ কিছুটা হলেও কমে। পুলিশ অফিসাররা জানান, ‘জাতীয় স্বার্থে’ ১০ দিন তাঁরা গণছুটি কর্মসূচি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সুবিচার না পেলে ফের আন্দোলনে নামারও হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। এদিকে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কারণে সিন্ধে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বহু দিন ধরেই পাকিস্তান সেনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছিল। পুলিশ বিদ্রোহ সেই ক্ষোভকে বিক্ষোভে পরিণত করেছে।
ডন পত্রিকার খবর অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন সিদ্ধ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুরাদ আলী শাহ। তিনি সিন্ধের পুলিশকর্তাদের নিয়ে নিজের বাসভবনে দীর্ঘ বৈঠক করেন। এই বৈঠকেই তিনি সেনাবাহিনীর আচরণে নিজের ক্ষোভ উগরে দেন। পরে প্রকাশ্যেও তিনি বিবৃতি দিয়ে পুলিশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনা চিরকালই গণতন্ত্রের চরম শত্রু। এবার পুলিশ বিদ্রোহ গণতন্ত্রপ্রেমীদের ক্ষোভকে সামনে নিয়ে এসেছে। মানুষের কণ্ঠ রোধ করে অবাধে লুটপাট আর মানুষের ওপর জুলুম কায়েম করাই হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনার ধর্ম। এখন সিন্ধের পরিস্থিতি তাঁদের কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে। ফের দাবি উঠতে শুরু করেছে পৃথক রাষ্ট্রের। সিন্ধ পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাইছে।
আপাতত পুলিশকর্তারা মহম্মদ বিদ্রোহে বিরতি টানলেও অশান্তির রেশ কিন্তু রয়ে গেছে। দীর্ঘ দিন ধরেই তাঁরা সেনা ও আইএসআইয়ের আচরণে ক্ষিপ্ত তাঁদের কাজে বাধা দেওয়াই শুধু নয়, পুলিশের সাধারণ কর্মী থেকে অফিসাররা পর্যন্ত সেনা অত্যাচারের শিকার। এবার খোদ আইজিপিকে অপহরণ করায় সেই ক্ষোভ মারাত্মক আকার নেয়। অপহরণের পরের দিনই দুজন অতিরিক্ত আইজিপি, সাতজন ডিআইজি ও ছয়জন সিনিয়র এসপি মর্যাদার পুলিশ অফিসার টানা ছুটিতে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সিন্ধের বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পাওয়া যায় পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষেরও। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন প্রাণ হারালেও তড়িঘড়ি সব খবর ধামাচাপা দিতে শুরু করে পাাকস্তানি সেনা। করাচি শহর কেঁপে ওঠে দুটি বিস্ফোরণে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবর গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সিন্ধ ও করাচিতে। গোটা পাকিস্তানই এখন সেনা অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুসছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পাঞ্জাব বাদ দিলে সব জায়গাই মাথা চাড়া দিচ্ছে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি। এর পেছনে কাজ করছে সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অমানবিক অত্যাচার। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি পাঞ্জাবি সেনার জুলুম ও অত্যাচারের কাহিনি বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালোই জানেন। সেই একই ধারা আজও বহন করে চলেছে পাকিস্তানি সেনা।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিরোধী নেতারাও। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ঘটনার নিন্দা করেছেন। সেনাপ্রধানকে গোটা ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তেরও দাবি তুলেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে। পাকিস্তানি জনতার কাছে অবশ্য ইমরানের গ্রহণযোগ্যতা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।