ইউক্রেনজুড়েই চলছে তুমুল যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে পশ্চিমা কোনো দেশই মাঠে নামেনি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, রুশ আগ্রাসনের তৃতীয় দিন শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, হামলা শুরুর পর থেকে ৩ হাজার ৫০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে। তাদের মরদেহ সরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে এই আহ্বান জানান ইউক্রেনের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেসচুক। তিনি বলেন, দখলদারদের হাজার হাজার মরদেহ ইউক্রেনে পড়ে আছে। মানবিক কারণে তাদের মরদেহ সরিয়ে নিতে হবে। তাই মরদেহগুলো রুশ ফেডারেশনে পৌঁছে দিতে রেড ক্রসের সহায়তা দরকার।
ইউক্রেন সেনাবাহিনী ফেসবুক পোস্টে জানায়, এ পর্যন্ত হামলায় জড়িত সাড়ে তিন হাজার রুশ সেনাকে হত্যা করা হয়েছে। বন্দি করা হয়েছে আরও ২০০ সেনা সদস্যকে। একই সঙ্গে রাশিয়ার ১৪টি যুদ্ধবিমান, ৮টি হেলিকপ্টার এবং ১০২টি ট্যাংক ধ্বংস করেছে ইউক্রেন।
তবে দেশটির এই দাবির সত্যতা তাৎক্ষণিক যাচাই করতে পারেনি বিবিসি। অপরদিকে রাশিয়া এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো তথ্য জানায়নি।
যুদ্ধে ইউক্রেনের ১৯৮ জন নিহত
মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ১৯৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এক লাখের বেশি বাসিন্দা।
শনিবার ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিক্টর লিয়াশকো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রুশ সেনাবাহিনী। তাদের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয় বৃহস্পতিবার। এতে ১৯৮ জন নিহত এবং ১ হাজার ১১৫ জন আহত হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে ৩৩ জন শিশু রয়েছে। তবে হতাহতদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক উভয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কি না, তা বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়নি।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা বলছে, প্রতিবেশী দেশে রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর পর এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের ১ লাখ ২০ হাজার বাসিন্দা পাশের দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।
শনিবার তৃতীয় দিনের মতো ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে রুশ বাহিনী। তারা শুক্রবারই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে প্রবেশ করেছে। রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করতে ইউক্রেনের সেনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে কিয়েভ। একই সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক ডেপুটি হাইকমিশনার কেলি ক্লেমেন্টস সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
কেলি ক্লেমেন্টস বলেন, ইউক্রেনের ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি বাসিন্দা পাশের দেশে গেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যে অভ্যর্থনা পাচ্ছে, তা অসাধারণ। কিন্তু সামনের দিনগুলোর কথা চিন্তা করে আমরা সত্যিই শঙ্কিত।
জানা গেছে, ইউক্রেনের বেশিরভাগ বাসিন্দা শরণার্থী হয়ে পাশের দেশ পোল্যান্ড, মলদোভা, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরিতে যাচ্ছে।
তৃতীয় দিনেও তুমুল যুদ্ধ
যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, কিয়েভে তুমুল যুদ্ধের মধ্যে একটি সড়কে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে শহরের একটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাজধানীর মাইডান স্কয়ারের কাছে একটি বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এছাড়া শহরের ত্রয়েশ্চিনা এলাকায় পাওয়া গেছে একাধিক বিস্ফোরণের খবর। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, হামলার শব্দ এত তীব্র ছিল যে, শহরের কেন্দ্র থেকে কয়েক মাইল দূর পর্যন্ত শব্দ পেয়েছেন তারা।
কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে, শহরের চিড়িয়াখানার কাছে এবং শুলিয়াভকা শহরের আশপাশে ৫০টিরও বেশি বিস্ফোরণ এবং ভারী মেশিনগানে গোলাগুলি হয়েছে।
আল-জাজিরা জানায়, পোল্যান্ডের সীমান্তের কাছে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর লভিভের মেয়র বলেছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনী শহরে রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করেছে।
লভিভের মেয়র আন্দ্রে সাডোভি টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে লিখেছেন, ইউক্রেনের সপ্তম বৃহত্তম নগর কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫৬ মাইল দূরের ছোট শহর ব্রডিতে তিনটি হেলিকপ্টার নিয়ে অবতরণ করেছে প্রায় ৬০ জন রুশ সেনা।
মেয়র বলেন, ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দখলদারদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে’।
রুশ সেনাদের ঠেকাতে মারিউপল শহরের অনেক সড়কে গাছ ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা। এমন অবরোধ পরিস্থিতির মধ্যেও সেখানকার অনেক বাসিন্দা আহতদের রক্ত দিতে হাসপাতালে ভিড় করছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক বলেছেন, মারিউপলে তীব্র যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া এই শহরকে জিম্মি বা আত্মসমর্পণ করাতে পারবে না।
অস্ত্র হাতে যুদ্ধের ঘোষণা পার্লামেন্ট সদস্যের
চলমান যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদেরও অংশ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সদস্য ও গলস পার্টির নেতা কিরা রুদিক বলেছেন, রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। তার কাছেও অস্ত্র আছে। যুদ্ধের জন্য তিনি প্রস্তুত।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে কিরা রুদিক বলেন, ‘আমি পার্লামেন্টের সদস্য। আমার দায়িত্ব রাজধানী কিয়েভে অবস্থান করা। ইউক্রেন সেনাবাহিনীর প্রতি আমার বিশ্বাস রয়েছে। তাদের হাতে অস্ত্র আছে। অস্ত্র আমার হাতেও আছে। আমি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত’।
কিয়েভের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে এই পার্লামেন্ট সদস্য বলেন, কিয়েভের আকাশে এখন একের পর এক বিমান হামলা হচ্ছে। বিস্ফোরণের শব্দে জানালা কেঁপে উঠেছে। তার বাড়ির পাশেও পরপর কয়েকটি বিমান হামলা হয়েছে। তবে এতে কেউ নিহত হয়নি।
ইউক্রেনের একটি শহর দখলের দাবি রুশ সেনাদের
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে মারিউপল বন্দরের পাশের শহর মেলিটোপল দখলে নেওয়ার দাবি করেছে রাশিয়ার সেনারা। শনিবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই দাবি করেছে বলে রয়টার্স ও বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, স্থানীয় সময় ২৬ ফেব্রুয়ারি রুশ সেনারা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই মেলিটোপলে প্রবেশ করে। স্থানীয় বাসিন্দারা শহরে টহলরত রুশ সেনাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর দেশটির প্রথম কোনা শহর দখলে নেওয়ার ঘোষণা দিল রাশিয়া।
প্রসঙ্গত, ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সেনা অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন। এর কয়েক মিনিট পরই ইউক্রেনে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়। এরপর থেকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৮ ঘণ্টা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
জেএইচটি