মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক সুন্নত এমন আছে যেগুলোর প্রচলন আরব অঞ্চলে আগে থেকেই ছিল।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দাড়ি লম্বা করতেন, লম্বা জুব্বা পরিধান করতেন, মাথায় টুপি ব্যবহার, টুপির ওপর পাগড়ি বাঁধতেন, চুল কাঁধ পর্যন্ত লম্বা রাখতেন, তিনি অতিথি পরায়ণ ছিলেন ও সব ধরনের লৌকিকতা মুক্ত থাকতেন।
এ সব সুন্নতের ব্যাপারে কারো মনে এ ধারণা আসতে পারে যে, এগুলোর কোনো গুরুত্ব ইসলামে নেই। এগুলো নিছক আঞ্চিলকতা। নবী করিম (সা.) যদি আরব অঞ্চলে না এসে পৃথিবীর অন্যকোনো অঞ্চলে আসতেন- তাহলে তিনি এগুলো করতেন না। আপনি যদি এ যুক্তির ওপর ভর করেন, তাহলে আরও অনেক কিছুরই ধর্মীয় গুরুত্ব আপনি হারিয়ে ফেলবেন।
নবী করিম (সা.) যদি মদিনা হিজরত না করে দিল্লি হিজরত করতেন, তাহলে দিল্লি হতো অন্য দিল্লি। অতএব, মদিনার আলাদা কোনো মর্যাদা নেই। জায়গা একটা হলেই হলো।
আল্লাহ যদি মক্কাতে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তিকে নবী না বানিয়ে লন্ডন জন্মগ্রহণকারী কাউকে নবী হিসেবে মনোনীত করতেন তাহলে লন্ডন হতো সম্মানিত লন্ডন। তিনি যদি আরবের লোক না হয়ে ব্রিটেনের লোক হতেন তাহলে তিনি ঠিকই জুব্বা না পরে প্যান্ট-শার্ট পরতেন।
তিনি যদি বঙ্গদেশে জন্ম নিতেন তাহলে তার ভাষা ও কোরআনের ভাষা হতো বাংলা। তাই আরবি ভাষার আলাদা কোনো মর্যাদা নেই।
এভাবে ‘যদি’ দিয়ে বলতে থাকলে পৃথিবীর সব ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, স্মৃতি, ঐতিহ্য, বিশেষত্ব ইত্যাদিকে অস্বীকার করতে হবে। এগুলোর কোনো কিছুরই কোনো মূল্য থাকবে না। এ সবক্ষেত্রে কেউ ‘যদি’ শব্দ দিয়ে কাজ নেয় না। বরং বাস্তবতাকে সবাই সবক্ষেত্রে মেনে নেয় এবং বাস্তবতা মেনে নিয়েই সবার আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, স্মৃতি, ঐতিহ্য ও বিশেষত্ব কাজ করে।
কাল্পনিক ‘যদি’র কোনো মূল্য নেই, বাস্তবটাই মূল্যবান ও গ্রহণযোগ্য। আপনি যাকে মা বলে শ্রদ্ধা করেন তার গর্ভে জন্ম না হলে অন্য একজন নারী আপনার মা হতো। তাই বলে কি আপনি বাস্তব মায়ের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সেবা ও দায়িত্ববোধ ভুলে যাবেন?
অনুরূপভাবে, নবীর ব্যাপারেও যা হয়েছে তাকেই মেনে নিতে হবে এবং নবী সংশ্লীষ্ট সব কিছুকেই ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। নবীর জন্মভূমি, নবীর হিজরত ভূমি, নবীর পোশাক, নবীর বেশ, নবীর ভাষা সবই মুসলমানদের কাছে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বস্তু।
রাসূল বিরোধী আবু জাহেল, আবু লাহাব, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই, উতবা, শায়বাসহ তৎকালীন আরবের প্রচুর কোরাইশ নেতা জুব্বা পড়েছে, লম্বা দাড়ি রেখেছে, পাগড়ি বেঁধেছে, টুপি পরেছে, আরবিতে কথা বলেছে। তাই বলে আরবি ভাষা ও জুব্বার মর্যাদা কমে যাবে না। কেননা রাসূল (সা.) এগুলো গ্রহণ করার দ্বারা এগুলোতে রাসূলের স্মৃতি প্রবল হয়ে গেছে।
এখনও জুব্বা, পাগড়ি, আরবি ভাষা আরব অঞ্চলের খ্রিস্টানরা ব্যবহার করে। এর পরও কিন্তু এগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলামি পোশাক বলেই বিবেচিত হয়।
মহানবী (সা.) আরব অঞ্চলের আঞ্চলিক সব প্রথাকে গ্রহণ করেননি। বরং যেগুলোতে আপত্তি ছিল তিনি সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মূর্তি ও মদ আরবের শুধু ঐতিহ্যই ছিলো না বরং এ দু’টি ছাড়া আরবদের ভাবাই যেত না। পিতার মৃত্যুর পর বিমাতাকে আরবরা নিজেদের জন্য বৈধ মনে করত। এমন অনেক রীতি ও প্রথা যা আরবে প্রচলিত ছিল- সেগুলোকে রাসূল গ্রহণ করেননি বরং নিষিদ্ধ করেছেন।
এ থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, আরবের যে সব রীতি, রেওয়াজ, প্রথা, বেশ রাসূল (সা.) গ্রহণ করেছেন কিংবা অনুমোদন দিয়েছেন- সেগুলো এখন আর আরবের সম্পদ নয়। বরং রাসূলের গ্রহণ ও অনুমোদনের কারণে সেগুলো এখন ইসলামের নিজস্ব সম্পদ। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের সম্পদ। সেগুলো এখন আর আরব ঐতিহ্য নয় বরং সারা পৃথিবীর সব মুসলমানদের ঐতিহ্য।
ইসলামের বিধানের মানদণ্ডে নির্দিষ্ট কিছু নীতি ঠিক রেখে যে কোনো পোশাক পরার অনুমতি বা বৈধতা ইসলামে রয়েছে। সেটা হলো- বৈধতার বিষয়। ইচ্ছা করলে শর্ত ঠিক রেখে একজন মুসলমান তার অঞ্চলের আঞ্চলিক পোশাক অবশ্যই পরিধান করতে পারবেন। এতে কোনো গোনাহ হবে না। কিন্তু নবী করিম (সা.) যে ধরণের পোশাক পরেছেন, যে বেশ গ্রহণ করেছেন সার্বিক বিবেচনায় তা অবশ্যই সুন্নতি পোশাক এবং তা পরিধান করা অন্য যে কোনো বৈধ পোশাক পরিধানের চেয়ে অবশ্যই উত্তম।
তাই কেউ যদি চায় তার পোশাক সর্বোত্তম হোক তাহলে তার জন্য করণীয় হলো- হাদিসের গ্রন্থাবলীতে পোশাক অধ্যায়ে নবী করিম (সা.)-এর পোশাকের যে বিবরণ দেওয়া আছে, সেগুলোকে সওয়াবের নিয়তে অনুসরণ করা। আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুফতি মাহফূযুল হক।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩
এসআই