ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ইসলামের সুমহান বার্তা

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৪
মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ইসলামের সুমহান বার্তা

১৯৪৭ সালে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে দেশ ভাগ হলো। নিজেদের দেশ নিজেদের মতো করে সাজিয়ে ইসলাম মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠল মুসলমানদের মন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা ধর্মীয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ভারত থেকে। কিন্তু মুসলমানদের সে আশা নিমেষেই বিনাশ হয়ে গেল।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা মুখে ইসলামের কথা বলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যারপরনাই জুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন ও আগ্রাসনের পথ বেছে নিল।

অন্যদিকে দুই দেশের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও এক জাতিসত্তার গুরুত্বপূর্ণ সব কয়টি উপাদানই অনুপস্থিত ছিল। যেমন ভৌগোলিক ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য, আদর্শ ও ভাবগত ঐক্যসহ সব বিষয়েই দুই দেশের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক ও ব্যবধান ছিল। এরই সঙ্গে ধর্মীয় বন্ধনও হালকা হয়ে গেল।

অ্যান্থনী মাসকারেনহাসের ভাষায়, ‘ইসলাম অবশ্যি পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের সাধারণ যোগসূত্র। কিন্তু পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে দুই অঞ্চলের পরস্পরের প্রতি সাধারণ ক্ষেত্রে ধর্ম খুব নগণ্য বন্ধন সৃষ্টি করেছে। ’ (দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ১৮)

পাকিস্তানিদের অব্যাহত শোষণ, জুলুম-নির্যাতন বাঙালি মুসলমানের মনে প্রতিরোধের সাহস সঞ্চার করল। তারা স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল।

সব শেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে তারা ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যায় মেতে ওঠে। এ অবস্থায় বাঙালিদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় ২৬ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে। তখন থেকেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পরিচিত।

স্বাধীনতার অর্থ

স্বাধীনতা বলতে আসলে কী বুঝায়? বাংলা একাডেমির অভিধান মতে, স্বাধীন—১. বাধাহীন, আজাদ, মুক্ত, স্বচ্ছন্দ। ২. নিজের বশে, অনন্য নির্ভর। ৩. সার্বভৌম, বিদেশি দ্বারা শাসিত নয় এমন। স্বাধীনতা- ১. স্বাচ্ছন্দ্য, বাধাহীনতা। ২. আজাদি। কাজেই স্বাধীন বাংলাদেশ মানে বিদেশিদের দ্বারা শাসিত নয়—এমন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালি স্বাধীনচেতা জাতি। তাদের রক্তমাংসে স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষী, বাঙালি জাতি কখনো বিদেশিদের শাসন মেনে নেয়নি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি চেয়েছিল। স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই তাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। কেউ বলতে পারবে না যে ‘একাত্তরের যুদ্ধ ছিল ধর্মযুদ্ধ কিংবা সে যুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে। ’ ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি জাতি কেবল ধর্মভীরুই নয়, ধর্মের প্রচণ্ড অনুরাগী।

স্বাধীনতা ও পরাধীনতার বৃত্তে মুমিনের জীবন

উদারবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বিকাশের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে অশুভ বলে গণ্য করে। পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ, নাস্তিক্যবাদসহ বহু মতবাদের জন্ম উদারবাদ থেকে। উদারবাদ ব্যক্তির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিলেও প্রকৃতপক্ষে সমাজজীবনে ব্যক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে জম্মগতভাবে স্বাধীন বলা হলেও তার জম্মও একটি প্রক্রিয়ার অধীন। তাই ব্যক্তির নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় স্বাধীনতা বলতে মানুষের সেসব অবাধ কাজকর্মকে বোঝায়, যা অন্যের অধিকার বা তদ্রূপ স্বাধীনতাকে খর্ব না করে সম্পন্ন করা সম্ভব। ’ (রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ২৬৩)

শব্দগত অর্থে স্বাধীনতা বলতে বোঝায় স্ব অধীনতা। এর অর্থ, পরের বা বাইরের কোনো অধীনতা তাকে স্পর্শ করে না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ স্বাধীনতা, যা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বীকৃত নয়। স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্রদাতা জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ‘স্বাধীনতা প্রসঙ্গে’ (On liberty)

বলেছেন, ‘অন্যের স্বাধীনতার ওপর ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে হস্তক্ষেপ করা একটি মাত্র ক্ষেত্রে সমর্থনযোগ্য আর তা হলো আত্মরক্ষা। ’ তিনি মানুষের কাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। এক. আত্ম সম্বন্ধীয় (self-regarding) দুই. অন্য সম্বন্ধীয় (other-regarding) । তিনি বলেছেন, ‘প্রথমোক্ত কাজের জন্য ব্যক্তি কারো কাছে দায়ী নয়। সে নিজের ওপর সার্বভৌম। আর অন্য সম্বন্ধীয় কাজের জন্য তাকে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই একচ্ছত্র স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। স্বাধীনতা ও পরাধীনতার বৃত্তেই ঘুরতে থাকে জীবনের চাকা। কেউ কেউ স্বাধীনতার অর্থ করেছেন আত্মসংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণ। স্ব অর্থ নিজ বা আত্ম। আর অধীনতা অর্থ সংযম ও নিয়ন্ত্রণ। তাই স্বাধীনতার কথা এলেই সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা চলে আসে।

ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে জন স্টুয়ার্ট মিল দার্শনিকদের মধ্যে একটি বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল, রাষ্ট্রাধীনে ব্যক্তি আসলে কতটুকু স্বাধীন? ইতিহাসের অবতারণা করে মিল বলেন, ‘আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। ’ (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কলাম, ‘ইতিহাসের আলোকে ব্যক্তিসত্তা, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র, দৈনিক ঢাকা রিপোর্ট, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪)

মুসলমানদের জীবনে স্বাধীনতার স্বরূপ

মুক্তি ও বন্ধনের সূতিকায় আবদ্ধ মানুষের জীবন। মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে, সমর্পিত হতেও ভালোবাসে। মানবচরিত্রের বৈচিত্র্য প্রবণতার এটিও একটি দিক। ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। তাই ইসলাম স্বাধীনতার কথা বলে। ইসলাম মানুষকে দেশপ্রেম ও স্বদেশচেতনায় অনুপ্রাণিত করে। স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দিতে সাহস জোগায়। স্বাধীনতা সুরক্ষায় দেশমাতৃকার ভালোবাসায় অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করতে উৎসাহিত করে। কিন্তু ইসলাম অবাস্তব ও কাল্পনিক উদারবাদে বিশ্বাস করে না। তাই ইসলাম মানবতার কল্যাণে ব্যক্তির জীবনে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। মহান সত্তার সঙ্গে মর্ত্যলোকের সংযোগ স্থাপন করেছে। ইসলাম মানেই আত্মসমর্পণ, আল্লাহর কাছে নিজের জীবনকে সঁপে দেওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘বলো, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ—সবই বিশ্বজগতের রব আল্লাহর জন্য। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২)

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক বিষয়েও ইসলামের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। মুুসলমানদের জন্য সেসব বিধি-নিষেধের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো...। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২০৮)

ইসলাম মানুষকে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতান্ত্রিকতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয়নি। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যোগ্য ব্যক্তির কাছে আমানত ও দায়িত্ব সমর্পিত করার নির্দেশ দিচ্ছেন। আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, ন্যায়ানুগভাবে তা করবে। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)

ইসলাম মানুষকে বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণ করার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু জিনা-ব্যভিচার নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম জুতসই ও পছন্দমাফিক পোশাক পরিধান করার স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু অশালীন পোশাক পরিধানে বারণ করেছে। ইসলাম মানুষকে পানাহারের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু অপচয় করতে নিষেধ করেছে।

ইসলাম মানুষকে অর্থ উপার্জনের তাগিদ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যায়, তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর রিজিক অন্বেষণ করো। ’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ১০)

কিন্তু ইসলাম অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধে ধনীদের সম্পদে একচ্ছত্র ভোগাধিকার দেয়নি। বলা হয়েছে, ‘তাদের সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের অধিকার আছে। ’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ১৯)

অর্থ উপার্জনে ইসলাম ব্যবসাকে বৈধ করলেও সুদকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। অর্থ উপার্জনের তাগিদ দিয়ে অসাধু উপায় অবলম্বনের পথ রুদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‌...‌আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সুদ হারাম করেছেন...। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৭৫)

মুমিনের জীবন বরাবরই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধি-নিষেধের অধীন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকে না। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৬)

ইসলাম শোষণমুক্তির কথা বলে। মানুষের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষকে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হতে শিক্ষা দেয়। কাজেই মুসলমানের প্রকৃত মুক্তি ও সফলতা হলো পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৪
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।