ঢাকা, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

‘স্মরণ’

সুলতানুল আউলিয়া খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহ.

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৯ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৫
সুলতানুল আউলিয়া খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহ.

আজ ১৪৩৬ হিজরির ১৯ জমাদিউল আউয়াল। আজকের তারিখে (১৯ জমাদিউল আউয়াল) ৫৩০ হিজরি সনে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আত্ম্যাতিক পুরুষ গরিবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন।

তাকে সুলতান-উল-হিন্দ (ভারতের সম্রাট) বলে অভিহিত করা হয়। তিনি গরিবে নেওয়াজ নামেও পরিচিত। কারণ, গরিব-মিসকিনকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ইরানের সিজিস্তান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দিন হাসান। মাতার নাম উম্মুল ওয়ারা। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। খাজা সাহেব মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। পৈতৃকসূত্রে তিনি একটি ফলের বাগান লাভ করেছিলেন। সুফি ইব্রাহিম কান্দুজি নামক একজন আল্লাহওয়ালা বুজুর্গের সংস্পর্শে এসে তার জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি একজন মানবসেবক ও আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনে কারিমে মুখস্থ সম্পন্ন করেন। পরে জ্ঞানার্জনের জন্য প্রথমে সমরকন্দ ও পরে বোখারা গমন করেন। বোখারায় তিনি মাওলানা শরফুদ্দিন ও মাওলানা হাসান উদ্দিনের ন্যায় জগদ্বিখ্যাত আলেমদের কাছে পাঁচ বছর এলমে শরিয়তের জ্ঞান অর্জন করেন।
 
কোরআন ও হাদিসের গভীর জ্ঞান অর্জন করার পর তিনি আত্মশুদ্ধির জ্ঞান অর্জনের জন্য হক্কানি পীর-মাশায়েখদের সন্ধানে সিরিয়া, হামাদান, কিরমান, তাবরিজ, বোখারা, সমরখন্দ, আস্তারাবাদ, হিরাত, বালখ প্রভৃতি স্থান সফর করেন।

অবশেষে ৩২ বছর বয়সে তিনি কোহে ফিরোজের শ্যামস কুঞ্জে অবস্থিত মাশহাদের বিখ্যাত পীর হজরত খাজা ওসমান হারুনি চিশতি (রহ.)-এর কাছে হাজির হন এবং তার হাতে বায়াত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে মনোনিবেশ করেন। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি পীরের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন এবং একজন পরিপূর্ণ মোমিন হিসেবে নিজেকে বিকশিত করেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত ও দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি-সাধকের সাথে সাক্ষাত করেন বলে নানা গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়। ভ্রমণের ধারাবাহিকতায় তিনি আরব থেকে ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

ভারতবর্ষে তার আগমনে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। সামাজিক নানা কুসংস্কার, শিরক ও বেদাতি কার্যকলাপ বিদূরিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় প্রচুর মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা। খাজা সাহেবের প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলের লাখ লাখ পথহারা সত্যবিমুখ মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।

ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তার এ সাফল্যের মূলে ছিল সুদৃঢ় ঈমান, কঠোর সাধনা ও নেক আমল। এছাড়া পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক, তেজোদীপ্ত প্রভাব বিস্তারকারী আধ্যাত্মিক শক্তি, আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ মানবসেবা, ইসলামি শিক্ষার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও তরিকার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রভৃতি।

শুধু তাই নয়, হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ইসলামের বাণী সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে অনেক খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এসব খানকা ছিল উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। সাধারণত জ্ঞান-পিপাসুদেরই এসব খানকায় থাকার অনুমতি দেয়া হতো।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর প্রজ্ঞায় পৃথ্বিরাজের শাসনামলেই আজমিরের বাইরেও বাদায়ুন, বেনারস, কনৌজ, নাগুর ও বিহারে খানকা তৈরি করেছিলেন। এসব খানকা থেকে প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় জিকির-আজকার ও কোরআন তেলাওয়াতের সুমধুর সুর আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলত। বলা চলে, এসব খানকা প্রতিষ্ঠা না করলে পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করা সহজ হতো না।

তবে একথা সত্য যে, তার আগমনের বহু আগেই ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ঘটে এবং অনেক সুফিসাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু খাজা সাহেবের আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপ্লব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়। ভারতবর্ষে তার আগমনে সময়- মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সাধারণ মানুষ উচ্চ বর্ণের লোকদের দ্বারা নিগৃহীত হতো প্রতিনিয়ত।

এমতাবস্থায় খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)এসব জাতিভেদ এবং স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাওহিদের দর্শন প্রচার করেন। ফলে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।

আল্লাহর এ খাস অলি ৬৩২ হিজরির ৬ রজব এশার নামাজের পর নিজ কামরায় প্রবেশ করেন এবং রাতের কোনো এক সময় সবার অজান্তেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তার বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দিন চিশতি (রহ.) তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন।

ভারতের আজমিরে অবস্থিত তারাগড় পাহাড়ের পাদদেশে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-কে দাফন করা হয়। প্রতিবছর ১ রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে তার সমাধিস্থলে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে সমবেত হয়।

অবশ্য তার কবরকে কেন্দ্র আজমিরে যে ধরনের কর্মকাণ্ড চলে এটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, এসবের মাধ্যমে মূলত তার আদর্শ ও শিক্ষাকেই প্রকারান্তরে পদদলিত করা হচ্ছে।

আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘন্টা, মার্চ ১১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।