ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চাই পারে মাদকের ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৭ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৫
ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চাই পারে মাদকের ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে

শুক্রবার ২৬ জুন, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে।

দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ১৯৮৭ সাল থেকে ২৬ জুন জাতিসংঘ ঘোষিত মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের অগ্রাধিকার তালিকার অন্যতম বিষয় মাদক সমস্যা। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ এ সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের পেছনে মাদকের অবৈধ ব্যবসা ও অপব্যবহার অন্যতম কারণ। মাদকাসক্তদের ৮০ ভাগ তরুণ-যুবসম্প্রদায়।
 
গত কয়েক বছরে দেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, অনেক উন্নত হয়েছে। কোনো এলাকায় একবার গিয়ে আবার যদি ছয় মাস পর যাওয়া হয়, তাহলে অনেক কিছুই চেনা যায় না। দেখা যায় অনেক নতুন চকচকে দালানকোঠা গড়ে উঠেছে। এসব প্রকারান্তরে দেশের উন্নয়নের চিত্র। তবে চকচকে এসব দালানকোঠা-দোকানপাটের পাশাপাশি আরেকটি সাইনবোর্ড এখন প্রায়শ চোখে পড়ে- ‘মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র। ’ এটাও কি দেশের উন্নয়নের চিত্র? অবশ্যই না। তবে এমন সেবাকেন্দ্র বৃদ্ধির কারণ কী? তাহলে কি দেশে মাদকাসক্তি বাড়ছে? আসলেই, এ আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়।
 
একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এখনকার তরুণরা এক ধরনের অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের মুখের ভাষা, স্মার্টনেসের নামে যোগ হচ্ছে কিছু উদ্ধত শব্দের অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ। নিয়ম ভাঙার প্রবণতা, রাত জাগার প্রবণতা, নিজের ঘরে একা থাকার প্রবণতা, খুব দ্রুত বন্ধুত্ব করা, ততোধিক দ্রুত বন্ধুত্ব ভেঙে ফেলা, মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন, দূরত্ব- এসব যদিও আগেও আমাদের সমাজে ছিল, কিন্তু এই মাত্রায় কি ছিল? এক ঐশী তার মা-বাবাকে একেবারে মেরে ফেলায় এত তোলপাড় হয়েছে, কিন্তু কত ছেলে ঐশী, কত মেয়ে ঐশী যে ঘরে ঘরে মা-বাবাকে রীতিমতো উপেক্ষা করে নির্লিপ্ত মূল্যবোধহীন একটি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, তার কতটুকু আমরা জানি!
 
আসলে সময় বদলে যাচ্ছে, সমাজ অস্থির থেকে আরও অস্থির হচ্ছে। বাড়ছে মাদকাসক্তি। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে তা নিয়ে কি আমরা যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করছি? কিছু পরিচিত কারণের কথাই আবার বলতে হয়।
 
পারিবারিক অস্থিরতা
আজকাল বিশেষ করে শহুরে জীবন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আত্মকেন্দ্রিক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অনুষ্ঠান ছাড়া দেখা হয় না। পরিবারের ছেলেমেয়েরা খুব একটা সময় পায় না মা-বাবার কাছ থেকে। দিন দিন তারা হয়ে পড়ে একা।
 
মূল্যবোধের অবক্ষয়
মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে দারুণভাবে। যে বয়সী ছেলেমেয়েরা আগে নানি-দাদির কাছে রূপকথার গল্প শুনতো, রাক্ষসের ভয়ে ঘুমিয়ে পড়তো, ওই বয়সী ছেলেমেয়েরা এখন নির্বিকার একা একা অথবা বন্ধুদের সঙ্গে হরর সিনেমা উপভোগ করছে। কত বীভৎসভাবে খুন করা যায়- তা দেখে পুলকিত হচ্ছে। আজকাল টেলিভিশনে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ সম্ভবত খুন, গুম, জবাই করে হত্যা ইত্যাদি। গা শিউরে ওঠা এই শব্দগুলো এখন সব সময় শোনা যাচ্ছে, আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তরুণদের এখন আর রক্ত দেখলে, খুনের খবর শুনলে গা ছমছম করে না। স্বাভাবিক আবেগ আন্তরিকতা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। পরিবারগুলো এখন ছোট ছোট।
 
মাদকের সহজলভ্যতা
গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, পেথিডিন ইত্যাদির হাত ধরে বাংলাদেশে এখন ইয়াবা সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য মাদক। মেথামফিটামিন নামক পদার্থ থেকে তৈরি এই মাদকটি একসময় ঠাণ্ডাজনিত অসুখবিসুখে ব্যবহৃত হতো। আরও ব্যবহার করা হতো ওজন কমানোর চিকিৎসায়। একসময় এটির ক্ষতিকর প্রভাব বোঝার পর এটি নিষিদ্ধ করা হয়। তারপর আস্তে আস্তে এটি মাদক হিসেবে চোরাইপথে আসা-যাওয়া শুরু করে।
 
সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এই ইয়াবা। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে এর ক্ষতিকর উপসর্গ। রাত কাটে নির্ঘুম, মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে। ঘাম আর গরমের অনুভূতি বাড়তে থাকে। একসময় এরা হয়ে পড়ে উচ্চ রক্তচাপের রোগী। দৃষ্টিবিভ্রম, শ্রুতিবিভ্রম, অস্বাভাবিক সন্দেহ করা থেকে শুরু করে সিজোফ্রেনিয়া, আত্মহত্যার প্রবণতার মতো বিরাট ঝুঁকিও বেড়ে যায়। যেকোনো মানসিক অস্থিরতাকে আত্মহত্যার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাদকের ‘জুড়ি’ নেই।
 
আমাদের করণীয়
যেহেতু আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত. বলতে গেলে তাদের সুখের জন্যই এক কিছু করা, তার পরও তারা বখে যাবে, এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। তাই, আমরা মনে করি সন্তানদের সুপথে রাখতে ও আনতে অভিভাবকদের নজরদারির কোনো বিকল্প নাই। সেই সঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখা দরকার-
 
আনন্দের উৎস হোক পারিবারিক বন্ধন
স্বাভাবিক পারিবারিক বন্ধনই হতে পারে আনন্দের উৎস, জীবনকে উপভোগের উৎস। অভিভাবকরা যদি আরেকটু আন্তরিক হন, আরেকটু মানসম্পন্ন সময় দিতে পারেন সন্তানদের, তবে ভালো ফল নিশ্চিত। পারিবারিকভাবে একটি আনন্দময় জীবন তরুণদের বিপথগামিতা থেকে নিরুৎসাহিত করে।
 
মূল্যবোধের চর্চা
মূল্যবোধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবজ্ঞা না করে এটিকে চর্চার ভেতরে রাখতে হবে পরিবার থেকে শুরু করে চাকরির ক্ষেত্রে, তথা সমাজে। বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, পশুপাখির প্রতি সদয় হওয়া, দুর্বলের প্রতি আন্তরিক হওয়া, সত্য কথা বলা, অন্যের ভালো সংবাদে খুশি হওয়া, মন্দ সংবাদে দুঃখিত হওয়া- এই স্বাভাবিক বিষয়গুলোও চর্চা করতে হবে একেবারে শুরু থেকে। বিশেষ করে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে।
 
ধৈর্য ধরে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা
মাদকে যত আসক্তই হোক না কেন, নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক-সুস্থ জীবনে ফেরা সম্ভব। প্রয়োজন ধৈর্য, ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো অন্যান্য উপায় অবলম্বন।
 
স্বজন, সুহৃদ ও প্রকৃত বন্ধু
সময় কাটানোর বন্ধু নয়; বরং প্রকৃত বন্ধুর সহযোগিতা, পরিবার ও স্বজনদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রে ওষুধের মতো কাজ করে। প্রকৃত বন্ধু নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
 
সামগ্রিক প্রতিরোধ
মাদকের কুফল সম্পর্কে উঠতি বয়স থেকেই তরুণ-তরুণীদের সচেতন করতে হবে। যত আগে থেকে তারা এই সম্পর্কে জানবে, তত তারা কম প্রলুব্ধ হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে বেছে নেওয়া যেতে পারে সেই মাধ্যমগুলো, যেগুলো তরুণ-তরুণীরা বেশি ব্যবহার করে, যেমন হালের এফএম রেডিও বা ফেসবুক।
 
কঠোর আইন ও প্রয়োগ
কোনো মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়লে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে যেসব পথে দেশে মাদক প্রবেশ করছে, সেসব জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। দেশের ভেতরে মাদক উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৫
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।