ঢাকা, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ভিক্ষুকদের প্রতি আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ?

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৫
ভিক্ষুকদের প্রতি আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ? ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

প্রতি বছর ১৭ অক্টোবর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস’। ১৯৯২ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

পালিত দিবসের নানা আলোচনা ও অায়োজনে দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে বিভিন্ন সূচক, পরিসংখ্যান, প্রস্তাবনা ও কর্মসূচি উঠে আসবে। যেসবের মূল কথা হলো- দারিদ্র্য মুক্তির জন্য সমাজে অনেক কর্মসূচি চালু থাকলেও দারিদ্র্যকে কোনোভাবেই পোষ মানানো যাচ্ছে না। দিন দিন এর প্রকোপ বেড়েই চলছে।

চলমান সময়ে দারিদ্র্যের ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যায় ভিক্ষাবৃত্তির হার দেখে। অথচ ভিক্ষাবৃত্তি ইসলামে নিষিদ্ধ। মানব সভ্যতার আদিম ও অলস পদ্ধতি ভিক্ষাবৃত্তি; যা জীবিকা অর্জনের পুঁজি ও প্রায় পরিশ্রমবিহীন উপায়। বিপন্ন মানুষকে সহায়তা এবং অনগ্রসর মানুষের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে ইসলাম দান-খয়রাতের বাধ্যবাধকতা ও উৎসাহ কোনোক্রমেই ভিক্ষাবৃত্তিকে সমর্থন করে না। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি করুণ ও উদ্বেগজনক বাস্তবতায় একটি কুপ্রথা হিসেবে টিকে আছে এবং এ কাজেও ইসলামের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলামি লেবাসকে। পরোক্ষভাবে এই ভিক্ষুকরা অপমান করে যাচ্ছে ইসলামকে। তাই সমাজকে এ দুষ্ট ব্যাধি থেকে মুক্ত করা জরুরি।

ইসলাম কতগুলো কাজকে শর্তসাপেক্ষে 'নিন্দনীয় বৈধ কাজ হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়; মূলত তা অধিকার নয় বরং সুযোগমাত্র। এগুলো হলো ঋণ গ্রহণ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি। '

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যের মুখাপেক্ষিতাকে কেবল সর্বনাশা অভাব আর অপমানকর দেনার ক্ষেত্রে অনুমোদন করেছেন। তিনি সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, 'যে অভাবের কথা মানুষের কাছে প্রকাশ করে তার অভাব দূর হবে না বরং যে তা আল্লাহর কাছে নিবেদন করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। ' –সুনানে আবু দাউদ

ভিক্ষাবৃত্তি এক অর্থে রিজিকদাতা আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থার পরিপন্থী। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেন, 'ভূপৃষ্ঠে এমন প্রাণী নেই যার রিজিকের ব্যবস্থা আল্লাহ রাখেননি। ' –সূরা হুদ : ৬

অন্যদিকে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'শক্তিসম্পন্ন ও সুস্থ-সবল ব্যক্তির পক্ষে ভিক্ষা করা হালাল নয়। ' –সুনানে তিরমিজি

ইসলামি শরিয়তের সিদ্ধান্ত হলো, যার কাছে একদিন-একরাত টিকে থাকার মতো খাদ্য অথবা জীবিকা অর্জনের অবলম্বনস্বরূপ সামান্য পুঁজি আছে তার পক্ষে ভিক্ষা করা হারাম। অনুরূপভাবে 'মিথ্যা আবশ্যক দেখিয়ে অথবা কৃত্রিম, বিকৃত রূপ ধারণ করে অন্যের সহানুভূতি প্রত্যাশা করাও হারাম। ' ইসলাম কর্মহীন বেকার জীবনকে সমর্থন করে না বলেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন সাহায্য প্রার্থীকে 'বনে গিয়ে কাঠ কাটার উপায় করে দিয়েছিলেন। '

আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তির বিচিত্র কৌশল ও মৌসুমি ভিক্ষুকের চিত্র অত্যন্ত করুণ এবং লজ্জাজনক। ভিক্ষুক নানা কৌশলে মানুষকে প্রভাবিত করে; কিন্তু আমাদের উচিত আরও সতর্ক থাকা। এ প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মোবারকের উদ্ধৃতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, 'কেউ আল্লাহর নামে সওয়াল করলে তাকে কিছু না দেওয়াই আমার নিকট পছন্দনীয়। '

ভিক্ষাবৃত্তির কিছু কারণ ও বাস্তবতা হলো- দারিদ্র্য, পারিবারিক অবহেলা, নিম্ন আয়, ভূমিহীনতা, অশিক্ষা, বসতবাড়ির অভাব, জনসংখ্যার চাপ, নারী নির্যাতন ইত্যাদি।

ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা খুব সহজ নয় এবং প্রায় সম্ভবও নয়। কিন্তু এ লজ্জা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দঃখজনক। কেননা অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তির প্রবণতা প্রকট নয়। প্রশ্ন মূলত এখানেই; এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

ভিক্ষাবৃত্তির নামে যা কিছু করা হয়, ইসলাম তা সমর্থন করে না। এর কারণ ও প্রতিকারের উপায় খোঁজা সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ ও প্রশাসনিক বিষয়। কিন্তু অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মতোই এখানে ধর্মীয় পরিচিতির প্রশ্নে ইসলাম চলে আসে- দুঃখ এবং প্রশ্ন এজন্যই। তবে এর জন্য ইসলাম বা এর শিক্ষা দায়ী নয়, দায়ী হলো সমাজবাস্তবতা।
ভিক্ষাবৃত্তি ইসলাম সমর্থন করে না। বৈধ জীবিকা অর্জন ইসলামে ফরজ ঘোষণা করে মহান আল্লাহ বলেন, 'যখন নামাজ সমাপ্ত হবে তখন ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহরাজি অন্বেষণ কর। ’ –সূরা জুমা : ১০

অথচ শুক্রবার যেন ভিক্ষুকের জন্যই! কর্মহীনতা পরিহার করার নির্দেশ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) স্পষ্ট উচ্চারণ, 'হালাল রুজি অন্বেষণ করা অন্যান্য ফরজের মতোই একটি ফরজ। ' –বায়হাকি

অক্ষমকে সহায়তা করা, তাকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করা রাষ্ট্র, সমাজ ও ধনীদের কর্তব্য। ঠিক তেমনই ইহ-পারলৌকিক ভাবনায় ব্যক্তিরও উচিত ভিক্ষাবৃত্তির ও পরমুখাপেক্ষিতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সংগ্রাম ও সাধনা করা। কেননা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কঠিন উচ্চারণ, 'যে নিজের মাল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যাচনা করে, সে নিশ্চয়ই দোজখের আগুন যাচনা করে। ' –মুসলিম

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, 'মানুষ সর্বদা লোকের নিকট ভিক্ষা করে পরিণামে তার মুখমণ্ডলে গোশত থাকবে না। ' –সহিহ বুখারি ও মুসলিম

রাষ্ট্রীয়, সামাজিক উদ্যোগ ও কঠোর ব্যবস্থা এবং ব্যক্তির কঠিন শ্রম আর সংকল্পই পারে ভিক্ষাবৃত্তির মতো সামাজিক অনাচার প্রতিহত করতে। কেননা ভিক্ষা কখনোই বৃত্তি নয়। বরং তা ইহ-পারলৌকিক ব্যর্থতার কারণ। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যে আমার নিকট অঙ্গীকার করতে পারে যে, সে মানুষের কাছে কিছু চাইবে না। আমি তার জন্য জান্নাতের অঙ্গীকার করতে পারি। ' –সুনানে আবু দাউদ

আর এভাবে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিলেই সমাজ থেকে দারিদ্র্যের হার কমে আসবে। আমরা রেখে যেতে পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটি সমাজ; যা বহুল প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ মানসিকতা কী আমাদের আছে?



বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৫
এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।