ঢাকা, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

পবিত্র আশুরা: যা করব, যা করব না

মুহাম্মদ আবদুল হাই, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৫
পবিত্র আশুরা: যা করব, যা করব না

আজ মহররম মাসের ৯ তারিখ। আগামীকাল (২৪ অক্টোবর, শনিবার) মহররম মাসের ১০ তারিখ।

মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরা নামে পরিচিত। আশুরা আরবি শব্দ। এর অর্থ দশম দিন। এ দিনটি ঐতিহাসিকভাবে খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। এ দিনে প্রাচীন আরবরা কাবার দরজা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখত।

কারবালার বিরল দৃষ্টান্ত
আল্লাহতায়ালা মহররম মাসের দশ তারিখকে কারবালার ঐতিহাসিক বিরল দৃষ্টান্তের জন্যও মনোনীত করেছেন। এ দিনে নবী দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) ও তার পরিবারবর্গ যে আত্মত্যাগের মহা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অপূর্ব। হিজরি ৬০ সনে ও ইংরেজি ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে এ দিনে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে স্মরণকালের মানব ইতিহাসের নির্মমতম হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সপরিবারে এদিন ফোরাতের কিনারে শাহাদতের পানি পান করেন। নীতি ও আদর্শের জন্য, সত্য ও ন্যায়ের জন্য অবলীলায় প্রাণ উত্সর্গ মানব ইতিহাসে সত্যিই বিরল। অপ্রতিরোধ্য বাতিল ও শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে তেজদীপ্ত ঈমানদারের দুর্বল প্রতিরোধের যে ইতিহাস আশুরার দিনে কারবালা প্রান্তরে রচিত হয়েছে, তা অনন্য ও কালজয়ী। যুগ যুগ ধরে এ ঘটনা মানুষকে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রত্যয়ী হওয়ার প্রেরণা জোগায়।

আমাদের করণীয়
মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই আশুরাতে সংঘটিত ঘটনাবলি মানবজাতির জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে রয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্রান্তিকালে করণীয় ও বর্জনীয় অসংখ্য নির্দেশনা এ আশুরার ঘটনাবলিতে বিদ্যমান। প্রতি বছর এ দিনটি যখনই মানুষের কাছে ধরা দেয়, তখনই মনে হয় যেন আশুরা তার শিক্ষার ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের নতুনভাবে ডাকছে। এ দিনের আবেদন ফুরানোর নয়। আর তাই আশুরাকে আমাদের সুন্দরভাবে উদযাপন করতে হবে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দিনকে যেভাবে উদযাপন করেছেন এবং উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদেরও ঠিক সেভাবেই উদযাপন করতে হবে।

আশুরার দিন রোজা রাখা খুবই ফজিলতের। তবে তার আগে অথবা পরে আরেকটি রোজা সংযোগ করতে হবে। যাতে ইহুদিদের রোজা প্রথা থেকে মুসলমানদের আশুরা পালন ভিন্ন হয়। আল্লাহর রাসূল (সা) সবসময় বিধর্মীদের অনুকরণ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।

আশুরার রোজা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল কিছু ইহুদিকে দেখলেন আশুরা দিবসে তারা রোজা পালন করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কিসের রোজা? তারা বলল, এদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে সমুদ্রে ডুবে মরার হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছেন। তাই মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এদিন রোজা পালন করেছিলেন। মহানবী (সা.) বললেন, আমি মুসার অনুসরণের বেশি উপযুক্ত এবং এ দিবসের রোজার বেশি হকদার। তিনি তার সাহাবাদের রোজা পালনের নির্দেশ দান করেন। -মুসনাদে আহমদ

তবে তিনি আশুরার রোজাকে ইহুদিদের রোজা থেকে পৃথক করার জন্য বলেছেন- ‘তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং ইহুদিদের থেকে ব্যতিক্রম কর। আশুরার একদিন আগে বা একদিন পরেও রোজা রাখ। ’

আশুরার দিন রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন- ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তিনি এক বছর আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। ’ -মুসনাদে আহমদ

হজরত মুসা (আ.) ও ইবরাহিমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া
আশুরার দিন হজরত মুসা (আ.)-এর বিজয়ের ইতিহাস স্মরণ করতে হবে। তিনি যেভাবে আল্লাহর পথে অবিচল থেকে ফেরাউনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদেরও বাতিলের পথকে রুদ্ধ করে ইসলামের আলোয় আলোকিত সমাজ গঠনের প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা গড়তে হবে।

কারবালার শিক্ষা বুকে ধারণ করা
আশুরার দিন কারবালা প্রান্তরে মানবেতিহাসের যে নির্মম কাহিনী রচিত হয়েছিল তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের মজবুত ঈমান। তাই আমাদের ঈমানি চেতনায় বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবন পরিচালনা করতে হবে।  

কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন (রা.) সপরিবারে আত্মত্যাগ করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, যে মস্তক আল্লাহর কাছে নত হয়েছে সে মস্তক কখনও বাতিল শক্তির কাছে নত হতে পারে না। আল্লাহর পথে অটল থাকতে মুমিনরা তাদের জীবনকে উত্সর্গ করতে দ্বিধা করে না। তাই আজকের মুসলমানরা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শপথ নিতে পারলেই কেবল আশুরার তাত্পর্য প্রতিফলিত হবে।

আশুরার বর্জনীয় বিষয়
আশুরার দিন ক্রন্দন-বিলাপ করা, বুকে চাপড়ানো, পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করা, নিজেকে রক্তাক্ত করা ও শোক মিছিল করা কোনোটিই শরিয়তসম্মত কাজ নয়। কোরআন-হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই। আশুরার দিন ভালো খাবারের আয়োজন করতে হবে, মুরগি জবাই করতে হবে- এমন ধারণা ও কুসংস্কার আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। ‘এদিন ভালো খেলে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে’-এ জাতীয় কথিত হাদিস শোনা গেলেও মূলত এ ধরনের কোনো বিশুদ্ধ হাদিস পাওয়া যায় না।

অতএব আশুরার দিন শোক, মাতম না করে এখান থেকে কী শিক্ষা নেয়া যায় সে চেষ্টাই করা উচিত। আমাদের আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, আশুরা মানে কারবালার ঘটনা নয়; এদিন ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা ঘটেছে। কারবালার ঘটনা ওই ঘটনাগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনা। যার মধ্যে মুসলমানের অনেক শিক্ষার বিষয় আছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তাওফিক দিন। আমিন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।