ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

বিশ্ববাসীর জন্য মেরাজের অনন্য উপহার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৮ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৬
বিশ্ববাসীর জন্য মেরাজের অনন্য উপহার

মেরাজ মানে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণ। এই পরিভ্রমণের ব্যবস্থা করেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা।

এই অলৌকিক সফরের সন-তারিখ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও মূল ঘটনা সম্পর্কে কারও কোনো দ্বিমত নেই। মেরাজ হয়েছিল হিজরতের আগে আর প্রচলিত মত অনুযায়ী তারিখ ছিল ২৭ রজব, রাতের কিছু অংশে। কোরআনে কারিমের সূরা বনি ইসরাইল ও সূরা নাজমে মেরাজের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক হাদিসে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। কাজেই মেরাজ অস্বীকার করলে কেউ মুসলমান থাকবে না। বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজ সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে, আত্মিকভাবে কল্পনার ডানায় ভর করে বা স্বপ্নযোগে হয়নি।

মেরাজের তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপে মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দাসে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যাওয়ার বর্ণনা সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে আছে। দ্বিতীয় ধাপে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমান পাড়ি দিয়ে নবীজী নিম্নজগতের প্রান্তসীমা ‘সিদরাতুল মুনতাহা’য় উপনীত হন। ষষ্ঠ বা সপ্তম আসমানে সিদরাতুল মুনতাহা ও নিকটে জান্নাতুল মাওয়ায় অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে সূরা নাজমের ১-১৮ আয়াতে। বেহেশত-দোজখ পরিদর্শন পর্যন্ত সফরসঙ্গী ছিলেন ওহিবাহক ফেরেশতা হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। তৃতীয় ধাপে হজরত জিবরাঈল (আ.) বিদায় নেন এবং নবীজি একাকী আল্লাহ সন্নিধানে গমন করেন। তিনি আল্লাহতায়ালাকে স্বচক্ষে দেখেছেন কি দেখেননি তা নিয়ে মতপার্থক্য অনেক জটিল। এটা আমাদের অালোচ্য বিষয়ও না।

গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সন্নিধান থেকে আমাদের জন্য কী এনেছেন বা আল্লাহতায়ালা মেরাজে নিয়ে নবীজীকে উম্মতের জন্য কী অমূল্য উপহার দিয়েছেন।

মুসলিম শরিফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর বর্ণনায় তিনটি উপহারের কথা উল্লেখ আছে-

১. পাঁচওয়াক্ত নামাজ, ২. সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, ৩. আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করলে অন্যান্য গোনাহ মাফ হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কিত ঘোষণা।

মুসলিম শরিফে মেরাজের বিশদ বিবরণ সংবলিত আল বুনানির বর্ণনায় আরেকটি উপহারের উল্লেখ আছে এভাবে-

যে ব্যক্তি কোনো সৎকর্ম করার মনস্থ করবে, তা বাস্তবায়ন করার আগেই তার জন্য একটি সওয়াব লিখে দেওয়া হবে। আর সে সংকল্প বাস্তবায়ন করলে দেওয়া হবে দশ গুণ সওয়াব। আর যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ করার মনস্থ করবে, যতক্ষণ সে কাজটি না করবে ততক্ষণ তার জন্য কোনো গোনাহ লেখা হবে না। যদি সে কাজটি করে বসে, তবে তার জন্য একটি গোনাহ লেখা হবে।

আল্লামা রশীদ উদ্দীন মাইবেদী প্রণীত তাফসিরে কাশফুল আসরারে আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূলের মাঝে একটি সংলাপের প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। সেই সংলাপ হলো ‘আত্তাহিয়াত’, যা আমরা প্রাত্যহিক নামাজে পড়ে থাকি।

আমরা মানসচক্ষে ভেবে দেখি, সমগ্র সৃষ্টির প্রতিনিধি হয়ে প্রিয় রাসূল আল্লাহর সমীপে উপনীত হয়েছেন আর আল্লাহতায়ালা আপন হাবিবকে সমগ্র মানবকুলের জন্য উপহার দিচ্ছেন। মেরাজের রাতের ওই অনন্য উপহারের মাঝে রয়েছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে গভীর সম্পর্ক, বন্ধন ও ভালোবাসা বৃদ্ধির সওগাত।

মহানবীর নবুওয়ত লাভের পরপর ফরজ হয়েছিল ইসলামের প্রধান বিধান ফজর নামাজ, মতান্তরে ফজর ও আসরের নামাজ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়েছে মেরাজের রাতে। এর প্রক্রিয়া ছিল বেশ চমৎকার ও গভীর তাৎপর্যময়। উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ বার আল্লাহর সমীপে হাজির হতে পারবে, এই উপহার নিয়ে নবীজী খুশিমনে চলে আসছিলেন আরশ হতে। ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.) পথ আগলে জিজ্ঞেস করলেন, কী পেলেন, কী নিয়ে যাচ্ছেন? নবীজী বললেন, দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ। হজরত মুসা (আ.) বললেন, আপনি গিয়ে সংখ্যা কমিয়ে নিন, দৈনিক পঞ্চাশ বেলা নামাজ আদায় করতে পারবে না আপনার উম্মত। মহানবী ফিরে গেলেন আল্লাহ পাকের সন্নিধানে। বলা হলো, তাহলে চল্লিশবার। ফিরে আসতে হজরত মুসা (আ.) আবারও জিজ্ঞেস করলেন। হজরত (সা.) বললেন, চল্লিশবার পেয়েছি। তিনি বুঝিয়ে বললেন, আমি বনি ইসরাইলকে নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। আপনিও পারবেন না, ফিরে যান, কমিয়ে আনুন। এভাবে প্রতিবারে ১০ ওয়াক্ত করে আর শেষবারে পাঁচ ওয়াক্তে কমানো হলো নামাজ। হজরত মুসা (আ.) এবারও ফিরে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। নবীজী বললেন, আমার আর যেতে লজ্জা লাগে। তখন গায়েবিভাবে ঘোষণা আসে, যারা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে তাদেরকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব দেওয়া হবে।

নামাজ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্কের প্রাত্যহিক অনুশীলন। নামাজের মূল অঙ্গ সূরা ফাতেহা পাঠের সময় আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সরাসরি কথোপকথনের যে বর্ণনা মুসলিম শরিফে আছে, তা নামাজের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের সাক্ষী।

মেরাজের পঞ্চম উপহার আত্তাহিয়াতের মধ্যেও প্রথম অংশ আল্লাহর সমীপে নবীজীর সালাম নিবেদন, তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালামের জবাব, এরপর নবীজীর সালাম গ্রহণ আর নবীজী ও আল্লাহর মাঝে এই সংলাপ শুনে আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সাক্ষ্যদান। নামাজের শেষ ভাগে আত্তাহিয়াত পাঠও প্রমাণ করে, নামাজ আসলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সম্পর্ক ও বন্ধনের অনুশীলন।

নামাজের মানসিক, নৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সুফলগুলো বাড়তি পাওনা মাত্র। মেরাজে নাজিলকৃত সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের মহিমাও অপরিসীম। হাদিসে বলা হয়েছে- এ হচ্ছে আল্লাহর আরশের নিচের দু’টি ভাণ্ডার। প্রথম আয়াতে সব নবী-রাসূলদের (আ.) প্রতি বিশ্বাস ও সম্মানবোধের সূত্রে বিশ্বসভ্যতার সঙ্গে একাত্মতা আর শেষ আয়াতে মহামহিম আল্লাহর কাছে সমর্পিত ও সমাহিত হওয়ার ঘোষণা।

সৎকর্ম সম্পাদনের আগেই শুধু ভালো চিন্তার বিনিময়ে একটি করে সওয়াব দেওয়ার ঘোষণা উম্মতের জন্য সর্বোচ্চ উপহার। আসলে চিন্তাই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে জাতির প্রতিটি সদস্য সৎ ও ভালো চিন্তায় অভ্যস্ত হবে, সে জাতির উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।

মেরাজের আলোচ্য উপহার আমাদেরকে সেই উন্নতির পথে, আল্লাহর সান্নিধ্যের পানে, পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফার দায়িত্ব পালনের চেতনায় উজ্জীবিত করুক। আমিন।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৭ ঘন্টা, মে ০৩, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।