ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

রাস্তার পাশে খাবারসহ ফ্রিজ!

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, সিনিয়র বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৭
রাস্তার পাশে খাবারসহ ফ্রিজ! সৌদি আরবে রাস্তার পাশে স্থাপিত এক ফ্রিজে খাবার রেখে যাচ্ছে দুই শিশু

একজন মানুষ যখন অন্য মানুষের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়ায়, যখন তার দুঃখ-কষ্ট ভোলাতে অবদান রাখে- তখন আল্লাহ খুশি হন। আর্তমানবতার সেবাকে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, হাশরের ময়দানে বিচারের দিন আল্লাহ মানুষকে লক্ষ্য করে বলবেন, আমি অসুস্থ, বস্ত্রহীন, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত ছিলাম তোমরা আমাকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করোনি, পরিধেয় বস্ত্র, ক্ষুধা নিবারণের অন্ন ও তৃষ্ণা টানোর কোনো পানীয় আমাকে দাওনি। মানুষ বলবে, হায় আল্লাহ! আপনি আবার কীভাবে রুগ্ন, ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন ও তৃষ্ণার্ত ছিলেন? উত্তরে আল্লাহ বলবেন, দুনিয়াতে আমার এক বান্দা তোমার বাড়ির পাশে রুগ্নাবস্থায় কাতরাচ্ছিল, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, বস্ত্রাভাবে লজ্জাস্থান ঢাকতে পারেনি, পানির পিপাসায় কাতর হয়ে জীবন ওষ্ঠাগত ছিল, তুমি তার প্রতি শক্তি-সামর্থ্য থাকাসত্ত্বেও কোনো দয়া করোনি, এগিয়ে আসোনি তার সমস্যা সমাধানে।

অসহায় রোগী, বস্ত্রহীন ও ক্ষুধার্ত, আমি তাকে বিশেষ হেকমতের কারণে করেছিলাম, তাকে সাহায্য করার অর্থ আমাকে সাহায্য করা, তাকে যেমন সাহায্য করোনি তাই আজ তোমাকে সাহায্য করবো না। -মুসলিম শরিফ

বর্ণিত হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, অভাবী ও বিপদাপন্ন মানুষকে সহায়তা করা সমাজের সম্পন্ন প্রতিটি মানুষের অবশ্য কর্তব্য। নিজেকে মুমিন হিসেবে পরিচয় দিতে হলে সমাজের অভাবী মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে।  

এ দায়িত্বশীলতার প্রেক্ষিতে এক সৌদি নাগরিক তার এলাকার রাস্তার পাশে দরিদ্র মানুষের জন্য খাবার ভর্তি ফ্রিজ রেখে দেন। ফুটপাতে এভাবে ফ্রিজ ও খাবার রাখার ঘটনা জনগণের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ২০১৪ সালে সৌদি আরবে হাইল এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি অবশিষ্ট খাদ্য ভরে ফ্রিজ রাখার বিষয়টি টুইটার, ফেইসবুক ইত্যাদি গণমাধ্যম এবং বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

এ ঘটনার পর অনেকেই তাদের গলিপথ ও স্থানীয় মসজিদের সামনে এ ধরনের খাদ্য ভর্তি ফ্রিজ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন, কেউ স্থাপন করেছেন। শেখ মোহাম্মদ আল আরেফি নামের এক ব্যবসায়ী তার টুইটার একাউন্টে এই কাজের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, হাইলের ওই সৌদি নাগরিক কাজটি করে পরোক্ষভাবে দানশীল কর্মেই সম্পৃক্ত হয়েছেন।

আরিফ আহমেদ নামক এক প্রবাসী বলেছেন, ‘এ কাজ মুসলমানদের গৌরবান্বিত করেছে। ’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি নাগরিকরা তাদের দয়ার্দ্র কাজের জন্য সুপরিচিত। লোকটি খাবারের অপচয়ের ব্যাপারে আমাদেরকে একটি মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছেন। যে কেউ ডাস্টবিনে খাবার না ফেলে এভাবে তা সহজেই দান করতে পারেন। ’

আবদুল আজিজ আহমদ নামক এক সৌদি নাগরিক তার বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, ‘এটা একটি চমৎকার অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। যখন অনেক ভিক্ষুক ও দরিদ্র লোক লজ্জায় খাবার কিংবা অর্থ চাইতে পারে না, তখন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের চারপাশে কেউ যেনো ক্ষুধার্ত না থাকে, তা নিশ্চিত করা। ’

সৌদি আরবের হাইলে ক্ষুধার্তদের সেবায় স্থাপিত ফ্রিজের ধারণাটি ইতিমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সৌদি আরবে ক্ষুধার্তদের জন্য রাস্তার পাশে ও প্রায় প্রতিটি মসজিদের পাশে রেফ্রিজারেটর রাখা হয়েছে। বাসা-বাড়ি বা হোটেলের অতিরিক্ত খাবার স্বেচ্ছায় এখানে রাখা হচ্ছে মুসাফির, পথিক বা গরিবদের জন্য। কারণ, শহরের আধুনিক ফ্ল্যাটে বসবাসকারী অনেকেই খাবার দান করতে চান, কিন্তু সামর্থ্য থাকার পরও তারা সেটা সময় ও লোক না পাওয়ার কারণে দান করতে পারেন না। এমতাবস্থায় রাস্তার পাশে স্থাপিত এসব রেফ্রিজারেটরে তারা খাবার রেখে যাচ্ছেন। আগে তারা রাতের বাড়তি খাবার অনেক সময় নিজেদের ফ্রিজে জায়গা না হওয়ায় ডাস্টবিনে ফেলে দিতেন। রেফ্রিজারেটর থাকার কারণে এখন ওইসব খাবার দীর্ঘক্ষণ ভালো থাকছে এবং যাদের খাবার ক্রয় করে খাওয়ার সামর্থ্য নেই তারা সেখান থেকে খাবার খেতে পারছেন।

গেল রমজান মাসে দুবাইয়ে রোজাদারদের জন্য ‘রমজান ফ্রিজ’ চালু করা হয়েছিল। সবার জন্য উন্মুক্ত এসব ফ্রিজ থেকে লোকজন ইচ্ছেমতো খাবার নিতে পারতেন। পুরো দুবাইজুড়ে এমন ১৫০টি ফ্রিজ রাখা হয়েছিল।

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ফিকলা ইয়েল নামে এক ব্যক্তি রোজাদারদের জন্য তার বাসার সামনে একটি রেফ্রিজারেটরে খাবার ও পানি রেখে দিতেন। সে সময় তার দেখাদেখি আরও কয়েকজন নিজেদের বাসার সামনের রেফ্রিজারেটরে খাবার ও পানি রাখা শুরু করেছিলেন।

অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি এমন সহানুভূতি প্রকাশ ইবাদতের অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য। মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে পারস্পরিক সহমর্মিতার রীতি চালু হবে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’- এই বার্তাটা আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠবে।  

মানবতার ধর্ম ইসলামে নিকটজন, প্রতিবেশী ও অধীনদের প্রতি সবসময় দায়িত্বশীল সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে মানুষকে নির্দেশ ও উত্সাহ দেওয়া হয়েছে। ইসলামের এই শিক্ষা যদি আমরা কাজে লাগাই, তাহলে পুন্য, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আমাদের সমাজ। সমাজের কাউকে আর না খেয়ে উপোস থাকতে হবে না।  

আমরা পেটপুরে খাচ্ছি, অথচ আমার পাশের কিংবা এই সমাজের ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর মুখে যদি একটু হাসি ফুটাতে না পারি- তাহলে আমরা বিবেকের কাছে কী জবাব দেবো? 

তাই বলি, আসুন! নিজের মানবিক মূল্যবোধ আর সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে তাকিয়ে সবাই যার যার সামর্থ্যানুযায়ী এমন একটি উদ্যোগ নেই, মানুষের পাশে দাঁড়াই।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।