ঢাকা, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

মদিনার পথে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
মদিনার পথে মক্কা থেকে মদিনার পথে। ছবি: বাংলানিউজ

মক্কা-মদিনা সুপার হাইওয়ে (সৌদি আরব): সুবেহ সাদেকের মোবারক হাওয়ার ঐশী ঔজ্জ্বল্যে হাজার হাজার নর-নারী উদ্ভাসিত। পবিত্র মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ আদায় করে দলে দলে মানুষ পথে নেমেছেন। কেউ হোটেলে যাবেন, কেউ নাস্তা সারবেন। কেউ কেনাকাটায় ব্যস্ত হবেন।

আবার কেউ কেউ মক্কায় অবস্থান শেষ হওয়ায় রওয়ানা হবেন মদিনার পথে। আসলেই, মক্কার ভোর মানে কর্মব্যস্ত দিবসের প্রকৃত সূচনা।

মক্কায় যারা নতুন এসেছেন, তারা চলেছেন বায়তুল্লাহ'র দিকে। ওমরাম, তাওয়াফ, সাঈ করবেন তারা। আল্লাহ’র ঘরের প্রতিটি দিক, প্রতিটি প্রবেশ পথ, সহস্র মানুষের আসা-যাওয়ার স্রোতে প্লাবিত হয়ে পরিণত হয়েছে এক বৈশ্বিক জনারণ্যে।

'ইয়া হাজজি, ইয়া হাজজি, ওমরাহ মোবারক, ওমরাহ মোবারক' বলে ফুটপাতের অস্থায়ী-ভাসমান দোকান থেকে ডাকছে দোকানিরা। অধিকাংশই আফ্রিকার নানা দেশের দরিদ্র নাগরিক। কিছু ভূতপূর্ব বার্মার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য। বিক্রেতা মূলত নারী, সঙ্গে সাহায্যকারী একাধিক সন্তান।

পাহাড় কেটে চলেছে মদিনার মহাসড়ক।  ছবি: বাংলানিউজদোকানগুলো ফিক্সড প্রাইসের। কোনটি ওয়াহেদ (এক), কোনটি খামসা (পাঁচ) বলে সমস্বরে চেঁচাচ্ছে বাচ্চা-কাচ্চাসহ দোকানি মা। খানিক সামনে এগিয়ে গেলেই 'খুবুরি জাদিদ' (নতুন ওভার ব্রিজ)। মিসফালাহ'র শেষ মাথায় মক্কা শহরের দিকে যাওয়ার রাস্তার উপরেই রিং রোডের মতো সার্কুলার রোড চক্রাকারে মসজিদুল হারামে প্রবেশের সব পথকে সংযুক্ত করেছে। এ মাথার নতুন ওভার ব্রিজ হযরত উমর (রা.)  এর নামে।   সেখানে দাঁড়ানো শত শত বিলাস বহুল বাস। যাত্রী নিয়ে চলেছে মদিনায়। সজল চোখে আল্লাহর ঘর 'বায়তুল্লাহ'কে বিদায় জানাচ্ছেন মানুষ। সামনের দিনগুলোতে আবার ফিরে আসার কাতর প্রার্থনায় মগ্ন সবাই।

শহর ছাড়তেই অসংখ্য হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে, আন্ডারপাস জালের মতো ছড়িয়ে আছে। পাথুরে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে পথঘাট। অপেক্ষাকৃত ঢালে পরিকল্পিত বসতি। আট লেন বিশিষ্ট সুপার মহাসড়কের দুই পাশে সঙ্গে চলছে সুরমা-রঙা কংক্রিট পাহাড়। ঊষর এবং উদ্ভিদ শূন্য। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে কাঁটা ঝোপ আর গুল্ম। কখনো মনে হচ্ছে ছোট-বড় বোল্ডারের আদি-অন্তহীন মহাসমুদ্রের ভেতর দিয়ে পথ চলেছে।

রাস্তার কোথাও কোথাও হাসপাতাল, পুলিশ ফাঁড়ি, পেট্রোল পাম্প। কোথাও খামার ধরনের জায়গায় শ্রমিকরা কাজ করছে। রাস্তায় দেখা পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গাড়িতে মাত্র একজন আরোহী নিজেই ড্রাইভ করে সবেগে চলে যাচ্ছে। পানির চেয়ে যে দেশের জ্বালানি তেলের দাম কম, সেখানে শ্রেণি ভেদে সবাই গাড়ি চালাতে পারে। বলা দরকার, সৌদিতে এক লিটার পানির বোতল এক রিয়াল (প্রায় তেইশ টাকা) আর পেট্টোল ৬০ পয়সা (পনের টাকার মতো)।

অকস্ম্যাৎ মাঝপথে মরু ঝড়ের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। কালচে লাল বালিতে আধাঁর ঘনিয়ে এলো চারপাশে। তীব্র বাতাসে মার্সিডিজ বেঞ্জ কোম্পানির মজবুত গাড়িও চলতে পারলো না। থেমে থাকতে হলো বেশ কিছুক্ষণ।

পথে আশা করেছিলাম উট দেখার। ট্রাকে মরুর জাহাজ উট আনা-নেওয়া দেখা গেলো। দুম্বা, ছাগল ইত্যাদিও ট্রাকে চেপে চলেছে নানা স্থানে। মক্কা থেকে মদিনা রেল লাইন তৈরি হয় নি। ফলে যাবতীয় সামগ্রী বিশাল যানবাহনে করেই সরবরাহ করা হচ্ছে।

চারিদিকে ঊষর পাহাড়।  ছবি: বাংলানিউজতেলের ট্যাংকার, মালের ওয়াগন, লম্বা লরি সড়কে চলছে সুষম গতিতে। পৃথিবীর প্রায়-সব নামি-দামি ব্র্যান্ডের ঝকঝকে নতুন গাড়ি চলছে লালচে ধুলা উড়িয়ে। কোনো হর্ন নেই। সজোরে ব্রেক কষার বলাই নেই। যানজট অকল্পনীয়। ছন্দের তালে তালে নির্দিষ্ট গতিতে সব গাড়ি নিজ নিজ ট্র্যাক ধরে এগিয়ে চলেছে।

৪৫০ কিলোমিটারের মক্কা-মদিনার দূরত্ব আয়াসপূর্ণ করতে পথে পথে রয়েছে অনেক মঞ্জিল। মঞ্জিল হলো এক ধরনের পান্থবাস। পেট্রোল পাম্প, ক্যাফে, মসজিদ, বাথরুম ইত্যাদি সজ্জিত স্টপেজ। দীর্ঘ যাত্রায় চালক ও আরোহীরা ইচ্ছা করলেই থেমে বিশ্রাম করতে পারেন। পথ শ্রমে আরাম আনতে চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে মঞ্জিলগুলোতে।

দুপুরের দিকে একটি মনজিলে থেমে আরবি কায়দায় ফ্লোরে আসন পেতে আহার সেরে নিলাম। সবই ঝোলহীন শুকনো খাবার। মশলা ছাড়া ভাজা মাছ বা মুরগি। সাথে কিসমিস, বাদাম দেওয়া পোলাওয়ের মতো রাইস। ফ্রি রুটি। আরবে দাম ধরা হয় তরকারি ভেদে, সাথে রুটি মুফৎ।

দেড় হাজার বছর আগে নবী এসেছিলে যে পথে সে পথ এখন আরামদায়ক। শত্রুর চোখ এড়িয়ে, পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে, খানা-খন্দ-পাকদণ্ডী পেরিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশ কয়েক দিনের কঠোর পরিশ্রমে পৌঁছেছিলেন ইয়াসরিব নামে এক জনপদে, যা এখন মদিনাতুন নাবী বা নবীর শহর। সেখানে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নাগরিক শান্তি ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যের অনুপম কেন্দ্র। সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ জন্মভূমি ছেড়ে মদিনাতেই শায়িত রয়েছেন। রাহমাতাল্লিল আলামিন হয়ে সমগ্র জগতের জন্য রহমত স্বরূপ তিনি রয়েছেন মদিনার সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট রওজা শরিফে।

মক্কার কবুতর চত্বর

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।