জাহাজ জলে ভেসে চলে এটা আমরা জানি। কিন্তু যদি শোনা যায়, জাহাজ জলের তলা দিয়ে চলে, তবে আমাদের প্রথমে একটু খটকা লাগে।
সব অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যই বোধ হয় জন্ম বিজ্ঞানের। বিজ্ঞান অনেক আগেই আবিষ্কার করে ফেলেছে জলের নিচ দিয়ে চলতে সক্ষম নৌযান। জলের নিচ দিয়ে চলা এ নৌযানের নাম সাবমেরিন। বাংলায় একে বলে ডুবোজাহাজ।
ঝড়-ঝঞ্ঝা, শত্রুর আক্রমণ, এমনকি প্রকাণ্ড হিমবাহে ঢাকা জলরাশিও একে আটকে রাখতে পারে না। সবার চোখের আড়ালে এটি পাড়ি দিতে পারে মাইলের পর মাইল। আর জলের নিচেই কাটিয়ে দিতে পারে মাসের পর মাস।
বর্তমান বিশ্বের এই অত্যাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা একদিনে এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। গবেষক ও আবিষ্কারকদের বিরামহীন অবদান একে ধীরে ধীরে বর্তমান রূপ দিয়েছে।
প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে এটি একের পর এক নতুন নতুন যোগ্যতা অর্জন করেছে। বন্ধুরা, আজ তোমাদের জানাবো কিভাবে এটি ডুব দিতে কিংবা পুনরায় ভেসে উঠতে শিখলো। পানির নিচেই বা কীভাবে চলতে শুরু করলো, কেনই বা পানির নিচে থাকা সত্ত্বেও এর আরোহীদের অক্সিজেনের অভাব হলো না।
১৫৭৪ সালে ডুবোযানের ধারণাটি প্রথম গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় নিয়ে আসেন ইংল্যান্ডের উইলিয়ম বৌর্নি। তিনিই প্রথম এ যানবাহনটির একটি নকশা করেন। তোমরা জেনে অবাক হবে, বৌর্নি কিন্তু কোনো প্রকৌশলী ছিলেন না। ছিলেন একজন গণিতবিদ ও লেখক। তিনি এমন একটি
নৌযানের প্রস্তাব করেন, যা জলের নিচে ডুবন্ত অবস্থায়ই চলতে পারবে। তার প্রস্তাবিত নকশায় নৌযানটিকে দেখানো হয় কাঠের কাঠামোর ওপরে চামড়ার আবরণ দিয়ে ঢাকা একটি যান হিসেবে।
তবে প্রথম ডুবোযান তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয় ডাচ উদ্ভাবক কর্নেলিস ড্রেবেলকে। ইংল্যান্ডের টেমস নদীতে ১২ থেকে ১৫ ফুট গভীরে চালিয়ে দেখান ইতিহাসের প্রথম ডুবোযান। এর কাঠামোটি ছিলো কাঠের। আর তার উপরেও পিচ্ছিল একধরনের চামড়ার আবরণ ছিলো। এর পেটের মধ্য থেকে বের হয়েছে বেশ কয়েকটি বৈঠা, যার সাহায্যে এটি পানির নিচে চলতে পারতো। আর দিক ঠিক করতো এর গায়ের সঙ্গে সংযুক্ত এক ধরনের চামড়ার লেজের সাহায্যে।
১৮৪৭ সালে ডুবোযানের প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। একজন নাম না জানা আবিষ্কারক উদ্ভাবন করেন একটি অভিনব পদ্ধতি, যা পরবর্তীতে আধুনিক ডুবোযানগুলোতেও ব্যবহৃত হয়।
তিনি তার সাবমেরিনে চামড়ার তৈরি কয়েকটি ব্যগ সংযুক্ত করেন। ব্যাগগুলো জলে পূর্ণ করে সে জলের ওজনে এটি ধীরে ধীরে ডুবতে পারতো আবার বিশেষ স্ক্রুর সাহায্যে জল বের করে পুনরায় ভেসেও উঠতে পারতো। তার এ আবিষ্কার ডুবোযান গবেষণায় একটি নতুন মাত্রা এনে দেয়।
১৮ শতকের শেষ পর্বে আমেরিকান বিপ্লবকে কেন্দ্র করে ডুবোযানের প্রযুক্তিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ডেভিড বুশনেল তৈরি করেন টার্টল নামক একটি ডুবোযান। এতে একজন নাবিক চড়তে পারতো। আর এটি চালানো হতো প্যাডেলের সাহায্যে প্রপেলার(নৌযান চালাতে ব্যবহৃত পাখা) ঘুরিয়ে।
১৮০১ সালে রবার্ট ফুলটন নামক বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন নটিলাস নামক ডুবোযান। এর অর্থায়ন করেন ইতিহাস-বিখ্যাত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। এটি তৈরি করা হয় লোহার কাঠামোর ওপর দস্তার পাত বসিয়ে। এতে জলের ওপরে এবং নিচে চালানোর জন্যে আলাদা আলাদা ব্যবস্থা ছিলো। জলের ওপরে চলার জন্য এর ছিলো একটি মাস্তুল ও পাল, যা পানিতে ডুব দেওয়ার সময় ভাঁজ হয়ে লেগে থাকতো। এটি পানির নিচে চলতো হাতে চালিত প্রপেলার বা পাখার সাহায্যে।
আমেরিকান নৌবাহিনী প্রবর্তিত প্রথম ডুবোযান হলো- অ্যালিগেটর। এটি প্রথম চালানো হয় ১৮৬২ সালে। এটি কম্প্রেসড এয়ার (বায়ুমন্ডলে প্রাপ্ত চাপের অধিক চাপযুক্ত বাতাস) ব্যবহার করে চালানো হয়। অ্যালিগেটরে সর্বপ্রথম ডুবন্ত অবস্থায় পানি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করার প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়। এ পর্যন্ত যতগুলো ডুবোযান তৈরি করা হয় তাদের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে বড়ো। এর দৈর্ঘ্য ছিলো ৪৭ ফুট। এতে ছিল ১৬টি হাতে চালিত প্যাডেল।
জ্বালানির সাহায্যে চালিত প্রথম সাবমেরিন বোট হল ইসটিনিও। এটি প্রথম যাত্রা করে বারসেলোনা থেকে, ১৯৬৪ সালে।
১৮৭০ সাল ডুবোযান নির্মাণের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ সময় ফরাসি লেখক জুল ভার্ন তার একটি সায়েন্স ফিকশন রচনায় এমন একটি ডুবোযানের কথা বলেন, যা ছিলো যুগের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে। তাঁর এ কল্পনা ডুবোযান বিষয়ক গবেষণাকে উৎসাহিত করে। এর পর থেকে ডুবোযান তৈরিতে ব্যাপক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসে।
আধুনিক ডুবোযানগুলি জলের নিচে প্রবেশ করা এবং পুনরায় জেগে ওঠার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি করা এক ধরনের ফাঁপা ট্যাংকের সাহায্য নেয়। এগুলোকে বলে ব্যালাস্ট ট্যাংক। যখন এটি জলের নিচে প্রবেশ করতে চায়, ট্যাংকগুলো জলে পূর্ণ করে নেয়। আর এর ওজনেই এটি জলের ওপর ভেসে ওঠে না। আবার ওপরে ভেসে উঠতে হলে এ ট্যাংকগুলোর জল নিঃসরণ করে খালি করে দেওয়া হয়।
ডুবোযানগুলি মূলত তিনটি শক্তির উপর নির্ভর করে চলতে পারে।
ডিজেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ব্যাটারি ও পারমাণবিক শক্তি। ডিজেল ইঞ্জিনের শক্তি শেষ হয়ে এলে ব্যাটারি প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু উভয়েরই শক্তি এবং ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। তাই আধুকি সময়ে ডুবোযান চালাতে ব্যবহৃত হয় পারমাণবিক শক্তি। এ শক্তি অসীম। এর উৎপাদনে কোনো অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না। ফলে এটি নিরবিচ্ছিন্ন শক্তি সরবরাহ করতে পারে।
ডুবোযানগুলো বর্তমানে যুদ্ধকালীন সময়ের উপযোগী করে তৈরি করা হয়। ফলে এতে পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র বহন করা হয়। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে যুদ্ধে এর ব্যবাহার জনপ্রিয় হয়।
বর্তমানে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন দৈত্যাকার সব সাবমেরিন রয়েছে। প্রতিটি সাবমেরিনকে যুদ্ধক্ষেত্রের জন্যে সর্বোচ্চ শক্তিশালী করে তৈরি করা হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে এটি অতর্কিতে শত্রু জাহাজ ধ্বংস করে দেয়। এটি নীরবে প্রাণ নিতে পারে হাজারো যোদ্ধার। তাই বিজ্ঞানের এই বিস্ময়কে বর্তমানে বলা হয় ‘সাইলেন্ট কিলার’ বা নীরব ঘাতক।
সাবমেরিনের কতগুলো সুবিধা:
ব্যক্তিগতভাবে একজন ব্যক্তি বিশ্বের যে কোনো এলাকার উপকূলে অদৃশ্যমান অবস্থায় গমন করতে সক্ষম। সেজন্য সাবমেরিনে ভ্রমণের সময় তাকে নৌপথ আবিষ্কারর কিংবা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়বে না।
নিরাপদ যানবাহন হিসেবে আকস্মিক ও অনিশ্চিত স্রোত এবং প্রবল ঝড়ের মোকাবেলা করতে হবে না। কেননা, সমুদ্র অভ্যন্তরের পাঁচ কিংবা ছয় পেস বা তের কিংবা পনের ফুট নিচ থেকে সাবমেরিনকে উপরে ওঠানো অসম্ভব ব্যাপার। এছাড়াও, জলদস্যু এবং ডাকাতের কবল থেকে, বরফ এবং জমাট হিমকণা থেকেও আত্মরক্ষার্থে এর ভূমিকা অসাধারণ।
পানির অভ্যন্তরে থাকায় ও আকস্মিকভাবে আক্রমণ করার মাধ্যমে নৌ-শত্রুদের বিরুদ্ধে এটি ব্যাপক সুবিধাদি বহন করে।
নৌ-অবরোধের প্রেক্ষাপটে ত্রাণকার্য পরিচালনায় অদৃশ্যভাবে খাদ্য কিংবা রসদ সরবরাহের মাধ্যম হিসেবে এটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি, ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com