ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

বাংলা বর্ণমালার ইতিকথা

মাইনুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩
বাংলা বর্ণমালার ইতিকথা

আমরা লেখার জন্য যেসব চি‎হ্ন ব্যবহার করি, তার একত্রিত নাম বর্ণমালা। আরেকটু খুলে বলি।

তুমি যাকে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ বলো সেগুলোকে একসঙ্গে বলে বর্ণমালা।

পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষারই আমাদের মতো লিপি আছে। এবার বলো তো, আমরা যে বর্ণমালায় লেখালেখি করি তার নাম কী? আমি জানি, তোমরা সবাই এক কথায় বলবে বাংলা বর্ণ। কিন্তু তোমরা কি জানো, আমরা এখন যে সুন্দর সুন্দর বর্ণ ব্যবহার করি, পূর্বে তা কেমন ছিল? এখন থেকে বারোশ’ বছর আগে সেগুলোর চেহারা যেমন ছিল তা দেখলে তুমি বিশ্বাস করতে চাইবে না যে, এগুলো আমাদের বর্তমান বর্ণমালারই পূর্বরূপ। যুগে যুগে এ বর্ণগুলোর আকার-আকৃতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

mপ্রাচীন কালে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজাদের শাসন ছিল। তারা পাথর খোদাই করে, কখনো চামড়ার উপর, আবার কখনো তামা, কাঁসা প্রভৃতি ধাতব পাতের ওপর রাজকীয় আদেশ, দলিল, ইতিহাস প্রভৃতি লিখে রাখতো। ফলে এ লেখাগুলো দীর্ঘদিন অক্ষত থেকে গেছে। আর আমরা ২০১৩ সালেও চাইলে তাদের লেখা বর্ণ কিংবা বাক্য দেখতে পারি। আর দেখতে পারি, আমাদের বর্ণমালার আগের চেহারা কেমন ছিল। বুঝতে পারি কীভাবে ধীরে ধীরে এসব লিপি থেকে বাংলা বর্ণমালার জন্ম হয়েছে।

বাংলা বর্ণমালার জন্মের জন্য আমরা সবচেয়ে বেশি ঋণী যে লিপির কাছে, তার নাম ব্রাহ্মি লিপি। কারণ, এ লিপি থেকেই যুগে যুগে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে এ লিপি প্রচলিত ছিল। এর নিদর্শন পাওয়া যায় রাজা অশোকের শাসন আমলের লেখা থেকে। এ সময়ের বর্ণগুলো দেখলে তোমার মনে হবে কোনোটি বড়শির মতো, কোনোটি ক্রুশ আবার কোনোটি ইংরেজি বর্ণের মতো।

খ্রিস্টীয় ১ম শতকে কুশান আমলে এ লিপির আরেক ধাপ পরিবর্তন দেখা যায়। এর পরবর্তী পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়Ñ গুপ্ত বংশের রাজাদের লেখায়। এ সময়ে স্বরবর্ণের আকৃতিগত পরিবর্তন হলেও, ব্যঞ্জনবর্ণের আকৃতিতে আসে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন।

গুপ্তযুগের পরেও এ পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত ছিল। প্রাচীন বাংলার একটি জনপদÑ গৌড়ের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তার শাসনামলেও বাংলা বর্ণমালার আকৃতিতে পরিবর্তন দেখা যায়। m2

বাংলা বর্ণমালার জন্মের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো সপ্তম শতক। এ সময়ে পেঁচানো আকৃতির এক প্রকার বর্ণমালার প্রভাব পড়ে সেই সময়কার আমাদের বর্ণমালায়। এই প্যাঁচওয়ালা লিপির নাম কুটিল লিপি। এই শতকের বর্ণগুলো দেখলে দেখবে বর্তমানে আমরা যেভাবে ‘অ’ লিখি, সেই সময়কার এ বর্ণটি এর অনেকটা কাছাকাছি দেখতে। আবার এ সময় থেকেই ‘ই’ এর লেজ জন্মাতে শুরু করে। আবার, আ-কার, ঐ-কার, এ-কারের উপরের অংশ তৈরি হতে শুরু করে।

কুটিল যুগের পরিবর্তন জন্ম দেয় প্রটো বাংলা লিপির। এ লিপিতে বাংলা লিপির বর্তমান চেহারার প্রথম সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তাই এর নাম প্রটো বাংলা লিপি বা প্রত্ন বাংলা লিপি। নবম শতকের মাঝামাঝি থেকে দশম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ লিপি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ সময়ে যেসব বর্ণ ছিল তার অনেকগুলো হুবহু বর্তমানে আমরা ব্যবহার করি। ‘ই’, ‘ঈ’, ‘উ’, ‘ঊ’, ‘ট’ প্রভৃতি বর্ণগুলির উপরের লেজ ছাড়া বাকি অংশ বর্তমানের মতোই ছিল।

বাংলা লিপির বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপটি লক্ষ করা যায় এগারো ও বারো শতকে। এ সময়ে যে লিপির ব্যবহার দেখা যায়, তার সঙ্গে বাংলা লিপির পার্থক্য খুবই কম। রাজা লক্ষণ সেন ও বিশ্বরূপসেনের সময়ে সাহিত্য রচনার কাজে বাংলা লিপির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতক পর্যন্ত বাংলা লিপিতে রচিত সাহিত্য তুমি চাইলেই দেখতে পারো। যেমনÑ চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ইত্যাদি।

কিন্তু বন্ধুরা তোমরা এখন কম্পিউটারের পর্দায় বা বইয়ের পাতায় যে বর্ণগুলো দেখতে পাচ্ছো, বলতে পারো, এ রূপটি আমরা কীভাবে পেলাম?

3mব্রিটিশ পণ্ডিত চার্লস উইলকিন্স ১৭৭৮ সালে পঞ্চানন কর্মকার নামের এক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা লিপির ছাঁচ তৈরি করেন। তারা এসময় হুগলীতে প্রথম বাংলা মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই বছরই এ মুদ্রণযন্ত্র থেকে প্রকাশিত হয় ব্যাকরণবিদ হ্যালহেডের অ Grammar of the Bangla Language নামক গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে প্রথম এ বাংলা টাইপ ব্যবহৃত হয়।

উনিশ শতকে বাংলা লিপির মুদ্রণে বাংলা টাইপের ধাতব অক্ষর তৈরি করা হয়। বিশ শতকে বাংলা টাইপিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে থাকে। এভাবে বর্তমানে বাংলা লিপি একটি চমৎকার স্থায়ী আকৃতি নিয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে কোটি কোটি মানুষের মনের কথা প্রকাশ করতে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।