একটি প্রশ্ন চমকে দিতে পারে সবাইকে। ভাষার রং কেমন? কিংবা ভাষার কি আদৌ কোনো রং আছে? উত্তর খুঁজতে মন পবনে মুহূর্তেই ঘুরে আসে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ গোলার্ধ।
রক্তে রাঙানো বাংলা ভাষার ইতিহাস। তাই আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, মন ছুঁয়ে যায় পৃথিবীর সব মানুষের। তাইতো আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালার ইতিহাস পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ সালে হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। খুব ভোর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাজ সাজ রব। বানের পানির মতো জড়ো হতে থাকে ছাত্ররা। জড়ো হতে থাকেন গাজীউল হক, মুহম্মদ সুলতান, এসএ বারীসহ অন্য ছাত্রনেতারা। সকাল ৮টা বাজতে না বাজতেই ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় আসতে শুরু করে। ৯টা সাড়ে ৯টার মধ্যে রীতিমতো বিপুল সমাবেশ ঘটে যায় ওই এলাকায়। মেডিকেল কলেজের আমতলায় তখন জমে গেছে প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রী।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, আমতলা, মধুর ক্যান্টিন সবখানেই ছোট ছোট জোট বেঁধে চলছে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। গুটি কয়েক ছাত্র ছাড়া সবাই ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতেই অবশ্য এ সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে এবং আন্দোলন বন্ধ করা চলবে না। আমতলার ছাত্রসভায় গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। স্লোগান উঠলো ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
বেলা ১১টা। ছাত্ররা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় গেটের সামনে। চারদিকে থমথমে উত্তেজনা। ছাত্ররা পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বেধে যায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। ইট-পাটকেল, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জের ধারাবাহিকতায় দুপুর ১টায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে আবার ঘটে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। হতাহত হয় অনেকে।
ওই দিন বিকাল সাড়ে ৩টায় হওয়ার কথা ছিল পূর্ববঙ্গ পরিষদ অধিবেশন। পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো ছাত্ররা পরিষদ ভবনের সামনে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের চেষ্টা জোরদার করেন। এই সময় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেটের সামনে ছাত্ররা সমবেত হয়ে গেটের বাইরে বের হয়ে আসার উদ্যোগ নিতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি চালায়। তার জবাবে ছাত্ররাও ভিতর থেকে পুলিশের ওপর ক্রমাগত ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এই সময় অনেকেই হতাহত হন। নিহত হন নাম না জানা অনেক ছাত্রজনতা।
২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদে গুলিবর্ষণে নিহত ও আহতদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী নিহত হয়েছিল সালাহুদ্দীন, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত এবং রফিক উদ্দিন। আহত সালাম মারা গিয়েছিলেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। নিচে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বাপর ঘটনা খুব সংক্ষিপ্তভাবে তোমাদের জন্য তুলে ধরা হলো-
শহীদ আবদুল জব্বার: ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলছিল। অন্যদিকে চলছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তখন মিছিল মিটিঙে উত্তপ্ত। একুশ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেই জব্বার ডাক্তারের পরামর্শে আবার বাইরে বেরিয়ে গেলেন তার অসুস্থ শাশুড়ির জন্য কমলা কিনতে। রাস্তায় বের হয়ে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে জব্বার ভুলে যান কমলা কেনার কথা। যোগ দেন মিছিলে। এ সময় পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় মিছিলে। অন্যদের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হন জব্বারও। ধরাধরি করে তাকে মেডিকেলে এনে ভর্তি করানোর পর মারা যান তিনি। সে সময় ঢাকায় কারফিউ থাকায় তার শাশুড়ির চিকিৎসক ডা. সিরাজুল ইসলাম জব্বারকে আজিমপুর গোরস্তানে দাফন করার ব্যবস্থা করেন। জব্বারের জন্ম ১৩২৬ সালের ২৬ আশ্বিন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানায়।
শহীদ আবুল বরকত: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ভিতরের তৎকালীন অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে শামসুল বারী বরকত সম্পর্কে লেখেন, আমার দিকে এগিয়ে এলেন বরকত, ডাক নাম আবাই। আবাই আমার হাত খানেক দূরে হঠাৎ পড়ে গেলন। তলপেটে গুলি লেগেছে তার। বরকতের গায়ে ছিল নীল রঙের ফ্লাইং হাফ শার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল। তখন তার দুই পা ডা. শফিকুর রহমান কাঁধে তুলে নিলেন আর মাথা নিলাম আমার কাঁধে। তার কোমরের নিচ দিয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরছিল। আমার কাছে পানি চাইলো, কিন্তু কোথায় পানি, সময় নেই। পুলিশের ভয়ে পড়িমরি করে ছুটছি আমরা। ভেজা রুমালটা চুষতে বরকতের হাতে ধরিয়ে দিলাম। বরকতকে নিয়ে এলাম ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। সে শুধু বললো, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচবো না। বিষ্ণুপ্রিয় ভবন, পুরানা পল্টনে সংবাদ পৌঁছে দেন...’। তারপর সব শেষ। অকালে ঝরে পড়লো কৃষ্ণচূড়া।
শহীদ রফিক উদ্দিন: মাথার ওপর ঠা ঠা রোদ। স্পট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপতাল। হাসপাতালের সামনে হচ্ছিল ছাত্রসভা। সভায় গুলি চালায় মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হন রফিক। তাই রফিককে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রফিকের জন্ম হয়েছিল ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানায়।
শহীদ সালাহুদ্দীন: তাকে দেখে কেউ কেউ কেঁদে ফেললো। একজন নার্স পাকিস্তানিদের ‘কাপুরুষ’ বলে গালাগালি দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বললেন গেটে যেতে। স্ট্রেচারে একটি মৃতদেহ। মাথার খুলি উড়ে গেছে। নিচের দিকে ঝুলছে খানিকটা ঘিলু। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র সালাহুদ্দীন হারিয়ে গেলেন সেদিন। যদিও তার নাম ইতিহাসের পাতায় খুবই গুরুত্বহীনভাবে স্থান পেয়েছে।
শহীদ সালাম: ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। চিকিৎসারত অবস্থায় সালাম মারা যান ২৭ ফেব্রুয়ারি। সালামের জন্ম ১৯২৭ সালের ২৭ জুলাই ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া গ্রামে। ‘ডাইরেক্টর অফ ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামক প্রতিষ্ঠানে তিনি পিয়ন পদে চাকরি করতেন।
ভীষণ মন খারাপ করা একটি দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার জন্য যারা অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলার দিন। যাদের রক্তের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ, তাদের নিয়ে কথামালা সাজাবার দিন। শুধু একদিন চঞ্চল নিঃশ্বাস ফেলা নয়, আমরা যেন সারা বছর তাদের স্মরণ করি। তাহলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে আরো দ্যূতিময় হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com