আমি স্কুল থেকে ক্লান্তি নিয়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে প্রতিদিন যখন বাসায় ফিরি, প্রতিদিনই দেখি একটা ছেলে ফুটপাতে শুয়ে ভিক্ষা করে। ওর পাশে লাল ছোট একটা গামলা থাকে।
পথচারীরা ছেলেটির পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। ছেলেটি পড়ে থাকে তাদের পায়ের কাছে। কেউ কেউ ওর গা মাড়িয়ে চলে যায়। মানুষ চলাচলের ফুটপাতে শুয়ে থাকলে হয়তো একজন মানুষের এটাই প্রাপ্য হওয়ার কথা। ছেলেটির দুটো হাতই কনুইয়ের উপর থেকে কাটা। একটা পা-ও বিকল। সোজা ভাষায় সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে কখনো অন্যদের মতো ভিক্ষা চায় না, কোনোদিন তাকে কথা বলতেও শুনিনি। আমার মনে হয় সে বাকপ্রতিবন্ধীও।
সেদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখি ছেলেটি ওর কাটা হাত দুটো দিয়ে খুব কষ্ট করে বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করছে। ও প্রতিদিন যেখানে শুয়ে থাকে, তার পাশেই একজন লোক ভ্যানে বাদাম বিক্রি করে। সে-ই হয়তো দিয়েছে। ছেলেটি বাদামের খোসা না ছিলেই খাওয়ার চেষ্টা করছে। অবশ্য ও খোসা কী করে ছিলবে, ওর কোনো হাতই যে কাজ করার উপযোগী নয়। এমতাবস্থায় একজন মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব হয়তো বাদামের খোসাটা ছিলে দেওয়া। কিন্তু আমি সেটা করলাম না। কেন করলাম না? হয়তো আমি আমার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে চাইলাম না। রাস্তার একটা ভিক্ষুক ছেলেকে বাদাম ছাড়িয়ে দেওয়া সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করাই বটে। আমি কী করলাম? আমি আমার হাতের ক্যামেরাটা দিয়ে একটি ছবি তুললাম। একটা মানুষ কাটা হাত দিয়ে বাদাম খাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। তোলার মতো দৃশ্যই তো। কে জানে, কোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারে। কী নিষ্ঠুর আমি! কী নিষ্ঠুর আমার চিন্তা-ভাবনা! দুর্নীতি-অমানবিকতা আর নিষ্ঠুরতার কালো মেঘে ঢাকা এই সমাজে থাকতে থাকতে আমিও বুঝি অমানুষ হয়ে গেছি। হতেই পারি। মানুষের কাজই তো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকা। সেখানে অমানবিকতা দোষের কিছু নয়।
আরেকদিন স্কুল থেকে আসছি। এবার ছেলেটিকে দেখে আমি সত্যিই অবাক হলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম আমি অমানুষ নই, আমি নিষ্ঠুর নই। যদি তাই হতাম, তাহলে নিশ্চই ওকে দেখে খুশিতে আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াত না? নিশ্চয়ই মনে হত না, আজ ওর মতো সাহসী-সংগ্রামী মানুষগুলোর জন্যই বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে? নিশ্চয়ই মনে হতো না, সারা দেশকে এনে দেখাই এই ছেলেটিকে? বলি, ওকে দেখে তোমরা শেখো।
মনে হচ্ছে কী এমন করল ছেলেটি? ও ওর কাটা দুটো হাত দিয়ে কোনোরকম ভাবে কলম ধরে সাদা খাতায় লিখছে! হ্যাঁ, কাটা হাত দিয়ে ছেলেটি লিখছে। ও লিখেছে ‘রাসেল’। বাংলায় আর ইংরেজিতে। ওর নাম বোধহয় রাসেল। আর লিখেছে অ থেকে ঔ পর্যন্ত। ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত। আরো অনেক কিছু লিখেছে। বাংলা ভাষায় লিখেছে। লিখেছে একটা লিফলেট দেখে, যা হয়তো হাতে পেয়ে অবহেলায় রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছে আমার মতো কেউ একজন। কী আশ্চর্য! আমি দাঁড়ালাম না। দৌঁড়ে বাসায় চলে এলাম। এসেই ক্যামেরা নিয়ে আবার রাসেলের কাছে গেলাম। এবার আমি ফুটপাতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম।
-এই? তোমার নাম রাসেল? জিজ্ঞেস করলাম ওকে। সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। আস্তে আস্তে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল।
-তুমি লিখতে পারো? কে তোমাকে লিখতে শেখাল?
-আমার ম্যাডাম। এই প্রথম কথা বলল রাসেল। আমার ভুল ভাঙলো। ও আসলে বাকপ্রতিবন্ধী নয়।
- কোন ম্যাডাম? তুমি স্কুলে পড়?
-পড়তাম।
-আচ্ছা রাসেল, তোমার হাত কী আগে ঠিক ছিল? রাসেলকে আমি জিজ্ঞেস করি। সে হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ল। কিন্তু সে জানাল এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। তবে কীভাবে এমন হল সেটা সে বলল না। আমি অনেকক্ষণ ওখানে থাকলাম। তারপর বাসায় চলে এলাম। এসে মামের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। মাম বললেন, একটি চক্র আছে যারা রাসেলের মতো দরিদ্র অসহায় শিশুদের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসে। তারপর জোর করে হাত-পা কেটে প্রতিবন্ধী বানিয়ে ভিক্ষা করতে নামিয়ে দেয়। আর তাদের আয় করা টাকাগুলোও চক্রের লোকেরা নিয়ে যায়। হায়রে মানুষ! হায়রে দেশ! এভাবে মানুষ স্বার্থের জন্য আরেকটা মানুষের এতবড় ক্ষতি করে দিতে পারে? আমি জানতাম না। আমি জানতাম সমাজ খুব নিষ্ঠুর, তাই বলে এতটা তা জানতাম না। আমি জানতাম মানুষ অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এতটা, তা জানতাম না।
আমি সেই যে একদিন রাসেলের সাথে কথা বলেছিলাম, ওর জন্য আমার এক অদ্ভুত মায়া জন্মে গেছে। জানি না, এটা করুণাও হতে পারে। ও প্রতিদিন আমাকে ফুটপাত দিয়ে যেতে দেখলে হেসে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে, ভালো আছেন আপা? রাসেলরা কত সহজেই খুশি হয়! আর আমরা? কেউ আমাদের জন্য জীবন দিয়ে দিলেও খুশি না।
আমিও হেসে উত্তর দিই, ভালো আছি। প্রতিদিন ওর পড়াশোনার খোঁজ নিই।
আমি রাসেলের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি শিখেছি, কীভাবে প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যেতে হয়, কীভাবে ঝড়ের ভেতরেও শক্ত হাতে নৌকার হাল ধরে থাকতে হয়। আমি শিখলাম কী করে সব জায়গা থেকে উৎসাহ নিতে হয়, প্রেরণা নিতে হয়। জীবনসংগ্রামের কিছুই আমি দেখিনি, কিন্তু দেখলাম। এই রাসেল আমাকে দেখাল। সে দেখাল কীভাবে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় এই পৃথিবীতে। আমি আরো একবার নতুন করে বাঁচতে শিখলাম ফুটপাতে আমাদের পায়ের কাছে পড়ে থেকে সংগ্রাম করে চলা সংগ্রামী এক রাসেলের কাছ থেকে।
লেখক: মীম নোশিন নাওয়াল খান
সপ্তম শ্রেণী, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি- ichchheghuri@banglanews24.com