ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

থ্যাঙ্ক ইউ মা, পুতুলটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে

মীম নোশিন নাওয়াল খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৩
থ্যাঙ্ক ইউ মা, পুতুলটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে

সুহা ঘুম থেকে উঠে দেখে মা বাসায় নেই। ডাইনিং টেবিলে তার জন্য নাস্তা রাখা আছে।

রান্নাঘরে কাজ করছে মিনা। উফ! মা-টা যে কী না! এই তো গতকাল সুহাকে বলল, কাল তোমার জন্মদিন, আমি কাল কোথাও বেরুব না। আমার লক্ষ্মী মামণিটার সঙ্গে বাসায় থাকব। অথচ দেখ, ঘুম থেকে উঠেই সুহা দেখে মা বাসায় নেই। সুহা ভেবে নিল, মা যতক্ষণ না আসছে, সে নাস্তা খাবে না। খাবে না, খাবে না, খাবে না। হুম। এটাই তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সুহা বসে আঁকাআঁকি করতে লাগল। ওদের বাসার কাজের মেয়ে মিনা এসে ওকে দেখে চিৎকার করে উঠল।

-সুহা আপু!!! টেবিলে দেখি সব খাবার পড়ে আছে। তুমি কিছু খাওনি? কী আশ্চর্য! এবার শরীর খারাপ করবে তো। আমি খালাম্মাকে কী বলব তখন?

-মাকে কিচ্ছু বলতে হবে না। মা আমাকে নিয়ে এক ফোঁটাও ভাবে? ভাবে না তো। কাল তো তোর সামনেই আমাকে বলল যে আজকে কোথাও যাবে না।   আর দেখ, সকালে উঠেই দেখি মা নেই বাসায়। কেমন লাগে? মা না আসা পর্যন্ত আমি কিচ্ছুটি খাব না। মুখ ভার করে বলল সুহা।

-এই দেখো! ও কী কথা সুহা আপু? খালাম্মা তো তোমার জন্য জন্মদিনের উপহার কিনতে গিয়েছে। তা বলে এত রাগ করলে হয়? আর জানো তো, আজকে খালাম্মা আবার খালাম্মার বন্ধুর অফিসেও যাবে। তোমার জন্মদিন উনাকে আসতে বলতে যাবে।

উপহার কিনতে গেছে মা? শুনেই মনটা ভালো হয় গেল সুহার। যাই হোক, সুহা কিছু খাবে না। মা না আসা পর্যন্ত সত্যিই ও কিছু খাবে না।

সুহা ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করল। একটা মেয়ে, তার দুইপাশে মা আর বাবা। সামনে একটা কেক। পিছনে ব্যানারে লেখা, হ্যাপি বার্থডে টু সুহা। সুহা অ্যারো চিহ্ন দিয়ে মেয়েটার পাশে নিজের নাম লিখল, মা আর বাবাটার পাশে লিখল আমার মা আর আমার বাবা। এটা আজ বিকেলের ছবি। সে অগ্রিম এঁকে ফেলেছে। আজ বিকেলে সে তার মা-বাবার সাথে এভাবে কেক কাটবে। সুহা খুব আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে কখন তার মা-বাবা ফিরবে। মা কী উপহারই বা দেবে তাকে? খুব জানতে ইচ্ছে হয় সুহার।

ঘড়িতে বেলা সাড়ে ন’টা বাজে। কলিংবেলের শব্দ শুনে ছুটে যায় সুহা। তার বাবা এসেছে। কী ব্যাপার! বাবার তো আসতে রাত হয়। আজ একটু আগে আগে বিকেলে আসার কথা, কিন্তু সকালেই ফিরল কেন? সুহা দেখল তার বাবার চেহারায় গভীর উদ্বেগের ছাপ। তিনি ওকে বললেন দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে। কোথায় যাবেন তা কিছু বললেন না। সুহা চটপট তৈরি হয়ে গেল।

বাবা রিকশায় করে ওকে নিয়ে গেলেন বাসস্ট্যান্ডে। এখানে অনেক মানুষ। এত্ত মানুষ কেন? ব্যাপারটা কী? বাসস্ট্যান্ডটা ব্যস্ত থাকে সবসময়, কিন্তু এত লোক তো হয় না! বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বাবা বললেন এখানে নাকী একটা বিল্ডিং ধসে পড়েছে। সেটার ভেতরেই নাকি সুহার মা ছিল। ছিল আরও অনেক অনেক মানুষ । বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন বাবা। কিন্তু সুহা তখনো পুরো বিষয়টা বুঝে ওঠেনি। ৮ বছরের ফুটফুটে মেয়েটা জানে না ভবন ধসে পড়া মানে কী, আর তাতে কিইবা হয়!

বাবা ওকে নিয়ে অনেক ছোটাছুটি করলেন। অনেক মানুষ একটা বিল্ডিংয়ের কিছু অংশ ভেঙে ছিত্র করে করে ঢুকছে। সেখান থেকে অনেক মানুষ বের করে আনা হচ্ছে। তাদের কারো গা রক্তে মাখামাখি, কেউবা কোনো কথা বলছে না, মেলছে না চোখও। অনেকে কাঁদছে। অনেক্ষণ পর সুহা দেখল কতগুলো মানুষ তার মাকে ওখ‍ান থেকে বের করে এনেছে। বাবা লোকগুলোর দিকে ছুটে গেলেন। বললেন, এটা আমার স্ত্রী।

লোকগুলো মাকে একটা বিছানার মতো জিনিসে শুইয়ে দিয়ে বলল, আহারে! মেয়েটা আপনার তাই না? বলে সুহাকে খুব আদর-টাদর করল আর সান্ত্বনা দিল। কারণটা কী সুহা বুঝতে পারল না। কেউ কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। সুহা তাদের ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। সে আগে তার মায়ের কাছে যাবে। মায়ের কাছ থেকে তার জন্মদিনের উপহার নিবে আর বলবে যে সে মায়ের উপর রাগ করে ছিল। বাবা সুহাকে মায়ের কাছে নিয়ে এলেন। সুহা দেখে তার মা চুপচাপ শুয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। মায়ের গায়ে রক্ত। সে যত্ন করে জামা দিয়ে রক্ত মুছে দিতে আগল। ডাকল, মা, মা? মা সাড়া দিল না। মা কী রাগ করে আছে নাকি? নাকি সুহাকে চমকে দিতে চাচ্ছে?

সুহা তার মায়ের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে গিয়ে দেখল মা শক্ত করে হাতে একটা প্যাকেট ধরে আছেন। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলতেই সুহা দেখে তার মধ্যে একটা বার্বি ডল। মা নিশ্চই তার জন্য কিনেছেন। সে খুশিতে গদগদ হয়ে পুতুলটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মায়ের নিথর শরীরের উপর ঝাঁপ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ মা, আমার পুতুলটা অনেক পছন্দ হয়েছে। এখন তুমি ওঠো তো, বাসায় চলো। আমি তো তোমার সঙ্গে খাব বলে কিচ্ছু খাইনি। মা কোনো উত্তর দেন না। সুহা আবার ডাকে, মা, মা? নাহ! মায়ের কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু আশেপাশের মানুষগুলো হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেন যে কাঁদে সুহা বুঝতে পারে না। সে ডাকতেই থাকে, মা, মা, বাসায় যাবে না? ওঠো না মা, বাসায় যাব। আমার খুব খিদে পেয়েছে তো... মা, ও মা, মা গো?

লেখক: মীম নোশিন নাওয়াল খান, সপ্তম শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।