সারাবছর আমাদের চারপাশে অসংখ্য ফুল ফোটে। এসব ফুলের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সাদা রঙের ফুলই বেশি।
নীলঘণ্টা
নাম শুনে মনে হতে পারে এ আবার কেমন ফুল! ঘণ্টা কোনো ফুল হয় নাকি। তবে ফুলটি দেখলে সত্যি সত্যি তাই মনে হবে। কারণ এরা ঘণ্টার মতো ঝুলে থাকে। অবশ্য এফুল দেখার জন্য যেতে হবে কোনো পার্ক বা উদ্যানে। ফুল ঝোপাল গাছগুলোর পাতার আড়ালে অনেকটাই লুকিয়ে থাকে। ভালো করে দেখে তারপর খুঁজে বের করতে হয়। ফুল ফোটে কিছুটা এলোমেলোভাবে। তাছাড়া সারাবছরই গাছগুলো অসংখ্য পাতার ঠাসবুননীতে ঢেকে থাকে। এ কারণে চট করে ফুল নজরে আসে না।
আজকাল প্রায় সব বাগানেই দেখা যায়। কখনো কখনো মাথা মুড়ানো ছোট ঝোপগুলো বাগানের সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। কেউ কেউ শুধুমাত্র বেড়ার জন্যও এ গাছ লাগান। তাতে ফুল ও পাতার সৌন্দর্য দুটোই পাওয়া যায়। নীলঘণ্টা (Thunbergia erecta) প্রায় সারাবছরই ফোটে এবং বাগান সাজানোর কাজে বেশ কার্যকর। গাছ প্রায় দেড় মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, শীতকালে অল্প সময়ের জন্য পাতা ঝরে। গাছ না ছেঁটে লতাও বানান যায়। পাতা ছোট, ৩ থেকে ৫ সেমি লম্বা ও মসৃণ। ফুল ফোটে পাতার কোলে, একেকটি বা সজোড়, গাঢ়-নীল বা নীল-বেগুনি, চওড়া ও সামান্য বাঁকা, ৩ সেমি লম্বা দলনল সাদা, ভিতর হলুদ, মুখ প্রায় ৪ সেমি চওড়া। গোড়ার চারা ও কলমে চাষ। আদিআবাস দক্ষিণ আমেরিকা।
নীলঅপরাজিতা
অপরাজিতা আমাদের অতি পরিচিত ফুল। রঙের কারণে বেশ নামডাকও আছে তার। গাছ লতানো, বাঁচে একবছর, পরে আবার চারা বানাতে হয়। গাছের গোড়ায় পানি জমলে আর বাঁচানো যায় না। এ কারণেই রোপণের সময় একটু উঁচু জায়গা বেছে নিতে হয়।
বাঁশের বেড়া, গেইট ও রেলিং বা যে কোনো বাহন পেলেই এরা বেড়ে উঠতে পারে। বিজোড়পত্রী, পত্রিকা ৫টি, কখনো কখনো ৭টিও হতে পারে, ডিম্বাকার। ফুল দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। একারণেই ইংরেজি নাম Butterfly Pea। আমাদের দেশে সাধারণত নীল, সাদা ও বেগুনি এই তিন রঙের অপরাজিতা দেখা যায়। তবে নীল অপরাজিতাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ইদানীং উন্নত জাতের বড় অপরাজিতাও চোখে পড়ে। গাছ চিরসবুজ। ফুল একপাপড়ি বিশিষ্ট। মাঝখানে একটি সাদা বৃন্ত থাকে। ফল লম্বাটে, চ্যাপ্টা ও বাঁকানো ধরনের। দেখতে অনেকটা শিমের মতো।
দেবী দূর্গার আরেক নাম অপরাজিতা। হিন্দুদের পূজার উপকরণেও এই ফুল কাজে লাগে। ধারণা করা হয় যে অপরাজিতার (Clitoria ternatea) জন্মস্থান মালাক্কা দ্বীপের টারনেটি নাম স্থান। ক্রমান্বয়ে ফুলটি এই উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফুলের প্রধান মৌসুম বর্ষা হলেও বছরের অন্যান্য সময়েও ফুল ফুটতে দেখা যায়। শুধু রূপেই নয়, অপরাজিতা ওষুধিগুণেও অনন্য। গাছের লতা, পাতা, শিকড় বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
নীলমণি
এই গাছের নীলমণি নাম আগে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ পেট্রিয়া নামের বিদেশি লতার গাছটির নাম রেখেছেন নীলমণি। নামটি একেবারে যথার্থ। নীলমণি যেন বসন্তের নীল প্রজাপতি। দূর থেকে মনে হয় নীল মেঘের একটা টুকরো হঠাৎ গাছে আটকে গিয়ে রঙের বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চলের এগাছ বেশ শক্ত লতানো ধরনের।
পাতাগুলো খুব বড় এবং খসখসে। বসন্তকালে অল্প সময়ের জন্য ফুল ফোটে। খবর পেয়ে মৌমাছিরা আসে দলে দলে পাপড়িগুলো দুই স্তরে সুসজ্জিত থাকে। বাসি ফুল রঙ বদলে প্রথমে বেগুনি পরে প্রায় সাদা রঙ ধারণ করে। বৈজ্ঞানিক নাম Petraea volubilis। ঢাকায় এফুল দেখার জন্য যেতে হবে শিশু একাডেমির বাগান, বলধা গার্ডেন এবং মীরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বনবাণী কবিতায় নীলমণি ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা লিখেছেন
‘ফাল্গুন মাধুরী তার চরণের মঞ্জীরে মঞ্জীরে
নীলমণিমঞ্জরির গুঞ্জন বাজায়ে দিল কিরে?
আকাশ যে মৌনভার,
বহিতে পারে না আর,
নীলিমাবন্যায় শূন্যে উচ্ছলে অনন্ত ব্যাকুলতা,
তারই ধারা পুষ্পপাত্রে ভরি নিল নীলমণিলতা। ’
ঝুমকালতা
এই ফুল দেখতে কানের ঝুমকার মতো বলেই হয়ত এমন নাম। আমাদের দেশে এখন অনেক বাগানে ফুলটি চোখে পড়ে। দেখতেও ভারি সুন্দর। গাছ চিরসবুজ, পাতায়ভরা ও লতানো। পাতার গোড়া থেকে গজানো একক আকষী দিয়ে অনেক দূর উঠতে পারে। কিন্তু উঁচু কোনো গাছে এই লতাটি উঠানো হয় না। বাগানে বেড়ার উপর বা বাঁকানো রেলিংয়ের উপর লাগানো হয়।
পাতা দেখেও খুব সহজে গাছ চেনা যায়। কারণ পাতার কিনারা গভীরভাবে বিভক্ত। এই অংশগুলোকে লতি বলা হয়। প্রতি পাতায় ৩ থেকে ৫টি লতি থাকে, সব মিলিয়ে ৮-১২ সেমি লম্বা। ফুল ফোটে গ্রীষ্মের শেষভাগে, থাকে গোটা বর্ষা। এ জন্য বর্ষার ফুল হিসেবেই পরিচিত। পাতার কোল থেকে একটি একটি করে সুগন্ধি ফুল ফোটে। পাপড়ি সংখ্যা ৫। মাঝখানের প্রায় ৫ সেমি চওড়া পরাগ মুকুট ফুলের প্রধান সৌন্দর্য। তাতে আছে অনেকগুলো সরু সরু ডাঁটা, বাইরের ডাঁটার নিচ বেগুনি, মধ্যে সাদা ও আগা নীল। জন্মস্থান ব্রাজিল। বৈজ্ঞানিক নাম- Passiflora caerulea।
মর্নিংগ্লোরি
মর্নিংগ্লোরির যদি বাংলা নাম দিই তাহলে নামটা হতে পারে ভোর গরবিনী। কিন্তু এই নামটা খুব একটা যুৎসই হলো না। তাহলে বরং ইংরেজি নামটাই থাকুক। নাম দেখেই বুঝতে পারছো গাছটি আমাদের দেশি নয়, তবে আমাদের দেশে এসেছে অনেক আগেই। দক্ষিণ আমেরিকা হচ্ছে আদিআবাস। তোমরা এই ফুলটি ঢের দেখেছো। আজকাল অনেক বাগানেই বেড়ার উপর বা নির্দিষ্ট কোনো বাহনে এফুল দেখা যায়। বর্ণবৈচিত্র্যের প্রধান কারণ তাজা আর বাসি ফুলের পার্থক্য। সকালে তাজা ফুলের রঙ নীলচে-বেগুনি, বাসি ফুলের রঙ লাল।
মর্নিংগ্লোরি কোমল লতার গাছ, সুযোগ পেলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পাতা দেখতে পান-পাতার মতো, ৭ থেকে ১১ সেমি লম্বা, আগা চোখা। সারা বছর কয়েকবার ফুল ফুটলেও গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বেশি থাকে। ফুল দেখতে অনেকটা মাইকের মতো। বৈজ্ঞানিক নাম- Ipomea indica.
কাঁটামেহেদী
সারা পৃথিবীর গরমের দেশগুলোতে এই গাছটি দেখা যায়। কোথাও কোথাও শুধু বাগানের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য আবার কোথাও কোথাও বাগানের বেড়া বানাবার কাজেও ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে বেড়া বানানোর কাজেই বেশি দেখা যায়।
ঝোপজাতীয় গাছ হলেও কখনো কখনো ১৫ ফিটের মতো উঁচু হতে পারে। পাতা উজ্জ্বল সবুজ, ৮ সেমি লম্বা, কিনারা করাতের দাঁতের মতো। নীলরঙের ফুলগুলো প্রায় সারা বছর ফোটে। পাপড়ি স্পষ্টভাবে বিভক্ত নয়, কিনারা সাদা রেখায় চিত্রিত। ফুল শেষ হলে বড় বড় ডাঁটিতে ফলগুলো থোকায় থোকায় ঝুলতে থাকে। হলুদ বা কমলা রঙের ফলগুলো ভারি সুন্দর। এই ফল পাখিদের প্রিয়। বৈজ্ঞানিক নাম- Duranta erecta.
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com