ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মাটির ব্যাংকে ঈদ | এমরুল হোসাইন

গল্প / ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৪
মাটির ব্যাংকে ঈদ | এমরুল হোসাইন

-কাফেরের মনেও চিন্তা হয় আর তোর মনে কোনো চিন্তা নাই! বেহায়া বেশরম কোথাকার! রমজানে দিন-দুপুরে সবার সামনে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম খাচ্ছিস? বেয়াদব কোথাকার! যা! দূর হয়ে যা! এক্ষণ আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা! ফাজিল কোথাকার!
-আহা! থাক না। কী এমন বয়স হয়েছে! ছেলে মানুষ।

আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ভাইজান।
-তোমার আশকারা পেয়েই ওর এই অবস্থা। আর বয়স কি কম হয়েছে? বিয়ে দিলে হালি হালি নাতি নাতনি থাকতো আমার ঘরে।
-কী করবেন ভাইজান, মা মরা মেয়ে!
-তাই বলে ভর দুপুরে আল্লাহ খোদার নাম নেই! রোজাদারদের সামনে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম খাবে? আর আমাকে তা বরদাস্ত করতে হবে!
-ভাইজান আমি ভালো করে বুঝিয়ে বলবো।
-হে আল্লাহ তুমি আমাকে মাফ করো! আসতাগফিরুল্লাহ হা রাব্বি মিন কুল্লি.....।
-আরে নিলুফা তুই! আয় আয়...। কোথায় গেলে, তাড়াতাড়ি এসো, দেখ কে এসেছে! কত দিন পর এলি। তা তোর ছেলেটা কোথায়? ওকে সাথে নিয়ে আসিস নি?
-ও পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত, তাই আসতে পারেনি ভাইজান।
     সবির মিয়া যেন মনে মনে একটু স্বস্তি পেল।
-পড়ালেখা সবার আগে, এটা নিয়ে হেলা-ফেলা করা ঠিক না।
-না ভাইজান ওর প্র্যাকটিকেল পরীক্ষা আছে, কয়েকদিন পর আসবে।
     সবির মিয়ার কপালে যেন একটু ভাঁজ পড়লো।
-তা ভাইজান আপনার শরীর কেমন? খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করছেন তো?
-করছি কোনো রকম।
-কেন? কোনো রকমে কেন?
-আর বলিস না! সামান্য আয় দিয়ে কী চলে! কোনোমতে বেঁচে আছি! কেন যে আবার বিয়া করতে গেলাম! এতটুকু মেয়ে রেখে ওর মা মারা গেলো, এরপর যদি আর বিয়ে না করতাম তাহলেই মনে হয় ভালো হতো, অন্তত একজনের খরচ তো বেঁচে যেত!
-বিয়ে না করলে তোমার সংসার দেখতো কে ভাইজান? কে তোমার বাবলিকে মানুষ করতো।
-মানুষ না ছাই হয়েছে! সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়, আর দেখো না! কেমন বেহায়া মেয়ে! রমজান মাসে দিনের বেলা নেচে নেচে আইসক্রিম খাচ্ছে!

-ফুপি তুমি কখন এলে?
-এই তো বাবলি, এখনি এলাম। তা তুই কেমন আছিস?
-আমি ভালা আছি, রতন কোথায় ফুপি? ওকে কতদিন দেখি না! সাথে নিয়ে আসলা না কেন?
-ও কয়েকদিন পর আসবে।
-ও আচ্ছা। ফুপা কোথায়?
-তোর ফুপা কয়েকদিন পর রতনকে নিযে একসাথে আসবে।
-নে মুমু এবার হাত মুখ ধুয়ে নে। ইফতারের সময় হয়ে এলো।

     সবাই মিলে একসাথে ইফতার শেষে সবির মিয়া একটু বিশ্রাম নিয়ে মসজিদে গেল তারাবি নামাজ পড়তে। গ্রামের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, এখানে সুরা তারাবি পড়া হয়। খতম তারাবি পড়াবার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু হাফেজ পাওয়া যায়নি। অল্প হাদিয়া দিয়ে হাফেজ রাখা যায় না। ওরা সবাই শহরে গিয়েছে, বেশি বেশি হাদিয়া পাওয়া যায় শহরে। তাছাড়া গ্রামের মানুষদের সারাদিন খেটে-খুটে রাতে অত লম্বা নামাজ পড়ার ধৈর্য কোথায়? শহরেও যে সবাই খতম তারাবি পড়ে, তা না। কিন্তু অনেক বাবা মা-ই ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে খতম তারাবি পড়াবার জন্য কারো সাথে মসজিদে পাঠিয়ে দেয়, তাই মসজিদে বেশ মুসল্লি হয়। সবির মিয়া তারাবি নামাজ শেষে বাড়ি এসে দুটো খেয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু রহিমা বিবির ফিসফিসানিতে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল তার।

-ভাইজান ওরা যে আসলো এখন কিভাবে কী করা? চাউল-ডাউলের যে অবস্থা তাতে কোনো রকম আজ রাত চলবে।
-ঠিক আছে আজ রাতটুকু চলুক, কালকে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এখন চুপ করে শুয়ে থাক।
     দুইজন পাশাপাশি চুপ করে শুয়ে রইলো। সবির মিয়ার প্রথম বউ ছিল টুকটুকে লাল, গ্রামের সেরা বউ বললেও ভুল হবে না। অনেক বেছে বেছে বাবা-মা বিয়ে করিয়েছিল। কিন্তু বিধিবাম! বিয়ের তিন বছরের মাথায় বউটা মেয়েটিকে এতিম করে রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো। সবির মিয়া আর বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু সংসারের চাপে আর পাড়া প্রতিবেশীদের পরামর্শে শিশুটির মুখের দিকে চেয়ে পাশের বাড়ির রহিমাকে বিয়ে করে। রহিমা বিয়েতে আমতা আমতা করলেও গরীবের ঘরে জন্ম নেওয়ায় তার মতামতের শেষরক্ষা হয়নি। বাবা মায়ের চাপে তুলনামূলক স্বচ্ছল সবির মিয়ার ঘরে আসতে বাধ্য হয়। তার একটি ছেলে হয়েছিল, বেশিদিন বাঁচেনি।

     সেহেরি খাওয়ার সময় হয়েছে, সবাই উঠেছে, আজকে বাবলিও উঠেছে ফুপির সাথে সেহেরি খাওয়ার জন্য। যদিও খাবারের পদ খুব বেশি না, সামান্য ছোটমাছের চচ্চড়ি আর পাতলা ডাউল, তবুও সবাই মিলে বেশ তৃপ্তি সহকারে সেহেরি খেলো। পরদিন সবির মিয়া সংসারের জন্য বাড়তি কিছু আয়ের চিন্তায় বের হয়ে পড়লো সকাল সকাল। সারাদিনে যা আয় হলো তা দিয়ে বাজার সদাই করে বাড়ি ফিরে এলো ইফতারের আগেআগে। দেখতে দেখতে ঈদ প্রায় চলে এলো, আর মাত্র দু’দিন বাকি। কী করা যায়! অনেক দিন পর ওরা এসেছে! রহিমা তাকে ভরসার বাণী শোনায়— চিন্তা করবেন না, এতদিন যখন চলেছে এখনো চলবে। তবুও সবির মিয়ার শঙ্কা দূর হয় না। ভাবতে ভাবতে আরও একদিন কেটে গেল। পরদিনও ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পুরোনো মাটির ব্যাংকটির কথা মনে পড়ে যায় তার। যে ব্যাংকটির সাথে আছে বউয়ের স্মৃতি, মরিয়মের বিদায়ের এতদিন পরও তা ভাঙেনি। তবে কী আজকে ভাঙবে! বসে বসে ভাবছে। আর ভেঙে কি খুব বেশি লাভ হবে? কত টাকা আছে কে জানে। সাইজ তো মাশাআল্লাহ বেশ। যদি এর সিকিভাগও ভরা থাকে তাহলে কয়েক হাজার টাকা হবে নিশ্চিত। কিন্তু মরিয়মের স্মৃতিটা ভেঙে ভেলবে? না! দেখি কারো কাছ থেকে ধার-টার কিছু পাওয়া যায় কিনা! ঈদের পর সুযোগ বুঝে শোধ করে দেয়া যাবে। পরদিন সবির মিয়া ছুটে চললো গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, কিন্তু ঈদের আগের দিন কেউ কি টাকা ধার দিতে চায়? আর তাছাড়া সবারই তো ঈদ, সবারই তো কেনা কাটা আছে! অভাবের সংসার হলেও সবির মিয়ার আত্নসম্মানবোধ আছে। তার অবস্থা এমনই যে, না পারছে যাকাতের টাকা নিতে, না পারছে অন্য কোনোভাবে টাকা সংগ্রহ করতে।

     আবার ছুটে চললো তার বন্ধুর কাছে কিছু পাওয়ার আশায়, বন্ধু তাকে পাঁচশ টাকার বেশি দিতে পারলো না। যাই হোক তবুও তো কিছুটা এগোলো। কিন্তু এতে কি চলবে! তাহলে কী করা? দেখতে দেখতে ইফতারের সময় হয়ে এলো। কী করবে? ভেবেছিল আর একটি দিন পর যদি ঈদ হয় তাহলে কিছু একটা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু ঈদের চাঁদ উঠে গেছে, কালকেই ঈদ। মেয়েটার জন্য ওর ফুপু জামা কিনে এনেছে এখন ওর ছেলে মেয়েদেরও তো কিছু দেওয়া চাই, কতদিন পর এলো! বোনটাকেও তো কিছু দেওয়া দরকার, নাকি? অবশেষে অনেক ভেবে-চিন্তে সবির মিয়া মরিয়মের স্মৃতিকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য মনস্থির করলো। মাটির ব্যাংকটিকে, যা এতদিন ধরে আগলে রেখেছিল, ভেঙে ফেললো। রহিমা অবশ্য বাঁধা দিয়েছিলে, লাভ হয়নি। রহিমা টাকা গোছাতে লাগলো। নাহ! খুব বেশি মনে হয় নেই! খালি খুচরো পয়সা আর এক টাকা, দুই টাকার নোটই বেশি। দশ টাকা, বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা আর একশো টাকার নোটও পাওয়া গেল কিছু! আবার গোছাতে লাগলো। এইতো একটি চকচকে নোট দেখা যাচ্ছে! পাঁচশো টাকার নোট মনে হচ্ছে! তাই তো! আরে এত দেখি একটি না, দুইটি! আবার গোছাতে লাগলো, আরও একটি দেখা যাচ্ছে, বাহ! কী আনন্দ! রহিমা বিবির আনন্দ যেন আর ধরে না। আপা দেখা যায় বেশ কাজের কাজ করে গেছে! সবির মিয়ার মুখে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও পরক্ষণেই ব্যথায় বুকটা চিনচিন করে উঠলো। কতদিনের পুরোনো সেই ব্যাংক! পাঁচশো টাকার নোট তিনটি দেখে রহিমা বিবি অবশ্য একটু বিস্মিত হলো। কিন্তু সবির মিয়া হলো না, কারণ সে জানে বিয়ের সময় নতুন বউ হিসাবে যা পেয়েছিল তার সবই মরিয়ম জমিয়ে রেখেছিল এই মাটির ব্যাংকে। রহিমা বিবি টাকা গোছানো শেষে সবির মিয়ার হাতে তুলে দিলো সব।

     সবির মিয়া বুকে চাপা ব্যথা নিয়ে বাজারে ছুটে চললো। টুকটাক যা পারলো সবার জন্যই কিনলো। রতনের পাঞ্জাবিটা বেশ পছন্দ হয়েছে, হাতের কারুকাজ করা পুরো পাঞ্জাবির অর্ধেকটা জুড়ে। বোনের জন্য কেনা শাড়িটাও বেশ চমৎকার হয়েছে আলপনা করা নীল পেড়ের লাল টকটকে শাড়ি।

     ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে সেমাই, পায়েস খেয়ে সবাই ঈদগাহে চললো। নামাজ শেষে কোলাকুলি করে ফিরে এলো বাড়িতে। আত্নীয়স্বজনদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করা হলো। মোনাজাত শেষে সবির মিয়া একটি কবরের পাশে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে কী যেন বলতে লাগলো। দূর থেকে সবাই বুঝতে পারলো সবির মিয়া প্রতিবারের মতো এবারও মরিয়মের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বউয়ের সাথে সুখ দুঃখের কথা বলবে। প্রতিবারই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কখনো হাসে, কখনো নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু এবার যে মুখ থেকে কিছুতেই হাসি বের হচ্ছে না! হঠাৎ কি জানি কী ভেবে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সবির মিয়া। কান্নার শব্দে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।