গতকাল থেকেই মন খারাপ সায়রার। এবার ঈদে ওদের যে দাদুবাসায় যাওয়া হবে না- সে খবরটা ও গতকালই পেয়েছে।
আব্বুর কথা অবশ্য ভিন্ন। তার মতে, ঈদের দিন ঢাকায় থাকার মতো আনন্দ নাকী আর হতেই পারে না। কী সব উদ্ভট কথা!
আম্মু তো আরো ভালো। আম্মু বলেন, তিনি নাকী সম্ভব হলে সারা বছর গ্রামে থেকে ঢাকায় এসে ঈদ করতেন!
সায়রার হয়েছে যত জ্বালা। কী যে করবে!
কিছু উপায় না পেয়ে মন খারাপ করে সেই সকাল থেকে এখনো বারান্দায় বসে আছে সায়রা। একটু আগে নিচে একটা হাফ প্যান্ট পরা খালি গা ছোট মেয়েকে দেখেছে। মেয়েটার সঙ্গে একটা ভীষণ মিষ্টি দেখতে বিড়াল। ওরা দুজন ছোটাছুটি করছিল। মাত্রই মেয়েটা চোখের আড়াল হয়ে গেছে। সায়রার আবার রাগ হচ্ছে। ওর খুব ভালো লাগছিল বিড়াল আর মেয়েটার দৌড়াদৌড়ি দেখতে।
কিছুক্ষণ পর আবার মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বিড়ালটার পিছন পিছন দৌড়ে বারান্দার নিচে রাস্তায় চলে এলো। এরপর ওটাকে কোলে নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আদর করে দিতে লাগল।
সায়রার হঠাৎ মনে হলো, অমন একটা বিড়াল থাকলে সে অনায়াসেই ঈদটা ঢাকায় কাটিয়ে ফেলতে পারত। ওই বিড়ালটা আর মেয়েটা কী ভালো বন্ধু! সেও তার সুন্দর বিড়ালের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব করতে পারত!
সায়রা চিৎকার করে আব্বু-আম্মুকে ডাকতে শুরু করল। তার চিৎকারে আব্বু-আম্মু দুজনই ভয় পেয়ে ছুটে এলেন।
‘কী হয়েছে সায়রা?’ জানতে চাইলেন আম্মু।
‘ঐ যে, ঐ মেয়েটাকে দ্যাখো। ওর কাছে কী সুন্দর একটা বিড়াল! আম্মু আমার ওই বিড়ালটা চাই। ’ আবদার করে সায়রা।
আব্বু বললেন, ‘কী মুশকিল! তুমি এই বাসায় বিড়াল এনে পালতে পারবে? কে দেখাশোনা করবে ওটার?’
‘কোনো বিড়াল আনা হবে না বাসায়। আমি কিন্তু দেখতে পারব না। আনোই যদি, তো তুমি দেখবে। ’ বললেন আম্মু।
‘বেশ। তোমরা এনে দিও না বিড়াল। যদি না এনে দাও, আমি কিন্তু কিছু খাব না। এখন থেকে আমি না খেয়ে থাকব। ’ এই বলে দৌড়ে ঘরে চলে যায় সায়রা।
সত্যি সত্যিই সারাদিন না খেয়ে থাকল সায়রা। কোনোভাবেই ওকে কিছু খাওয়ানো গেল না। অবশেষে আব্বু-আম্মু রাজি হলেন ওকে একটা বিড়াল কিনে দিতে। কিন্তু তাতেও হবে না। সায়রার ঠিক ঐ বিড়ালটাই লাগবে। অন্য কোনো বিড়াল কিনে দিলে হবে না। কী আর করার! আব্বু নিচে গিয়ে মেয়েটার সঙ্গে কথা বললেন। অনেক বোঝালেন, অনেক বললেন সায়রাকে ওর বিড়ালটা দিয়ে দিতে। ওকে টাকাও দিতে চাইলেন। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই রাজি হলো না। এরপর মেয়েটার মা কাজে থেকে এসে সবটা শুনে মেয়ের কাছ থেকে বিড়ালটা কেড়ে নিয়ে সায়রার বাবার হাতে তুলে দিলেন। সায়রার বাবা অনেকগুলো টাকায় বিড়ালটা কিনতে চেয়েছিলেন বলেই এমনটা করা। এই টোকাই মেয়েটার পরিবার হতদরিদ্র। টাকাগুলো তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের বিড়ালটাকে হারিয়ে মেয়েটা যতটাই কষ্ট পেল, ওটাকে পেয়ে সায়রা ততটাই খুশি হলো। বিড়ালটাকে আম্মু গোসল করিয়ে দিলেন। সায়রা ওকে কোলে নিয়ে খেলতে গেল। কিন্তু বিড়ালটা ওকে আঁচড়ে দিতে এল। ওর সঙ্গে মোটেই খেলল না। সায়রার খুব মন খারাপ হলো। আব্বু বললেন, ‘সায়রা, বিড়ালটা তো তোমার না। তাই ও তোমার সঙ্গে খেলতে চাইছে না। ও তো ঐ মেয়েটার সঙ্গে খেলে অভ্যস্ত। ওর সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছে বিড়ালটার। তাই ও কেবল ওই মেয়েটার সঙ্গেই খেলবে। আমি তো আগেই বলেছিলাম তোমাকে, একটা নতুন বিড়াল কিনে দিই। ’
সায়রা আব্বুর কথা শুনে কষ্ট পেল ঠিকই, কিন্তু হাল ছেড়ে দিল না। ও বিড়ালটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার অনেক চেষ্টা করল। তাতে কাজ তো হলই না, বরং বিড়ালটা পালিয়ে যেতে চেষ্টা করল। সায়রা তখন ওকে খাঁচায় আটকে রাখল। আব্বু-আম্মু অবশ্য বারবার বলল বিড়ালটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু সায়রা কারো কথা শুনল না।
সায়রার ধারণা ছিল হয়তো আস্তে আস্তে বিড়ালটা পোষ মেনে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিড়ালটা মোটেই পোষ মানল না। সে কিছু খায়ও না, শুধু অসহায়ভাবে মিঁউ মিঁউ করে। সায়রা প্রতিদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায়, সেই মেয়েটা নিচে রাস্তায় একা একা মনখারাপ করে বসে থাকে। তবুও সায়রা বিড়ালটাকে ছেড়ে দিল না, চেষ্টা চালিয়ে গেল ওকে পোষ মানাতে।
দেখতে দেখতে ঈদ চলে এল। কেনাকাটা করতে ব্যস্ত দিন কাটে সায়রার। নিজের জন্য কয়েকটা জামা, জুতো, ক্লিপ,ব্যান্ড- অনেক কিছু কিনল সায়রা। এখন তার মনটা বেশ ভালো আছে। বিড়ালটা এখনো পোষ মানে নি, তবে এখন খাওয়া-দাওয়া করে। আগের মতো সারাদিন মনখারাপও করে থাকে না। সায়রা জানে, এভাবেই আস্তে আস্তে ও পোষ মেনে যাবে, সায়রার খেলার সাথী হয়ে উঠবে। তবে ওই মেয়েটা অবশ্য এখনো বিকেলবেলা রাস্তায় বসে থাকে, মাঝেমধ্যে সায়রাদের বারান্দার দিকে তাকায়। সায়রার চোখে চোখ পড়লে মাথা নিচু করে ফেলে।
এমন করে রোজার দিনগুলো কেটে গেল। আজকে ঈদ। সায়রা অনেক খুশি। বিড়ালটার কারণে ঢাকায় ঈদ করা নিয়েও তার কোনো দুঃখ নেই। সায়রা ভেবেছে আজকে বিড়ালটাকে খাঁচা থেকে বের করবে। গলায় একটা সুন্দর ফিতা বেঁধে দেবে। নতুন জামা গায়ে দিয়ে সায়রা বিড়ালটাকে নেওয়ার জন্য বারান্দায় এল। বারান্দায় আসতেই তার চোখে পড়ল রাস্তায় খালি গায়ে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। মনে হচ্ছে যে এখুনি কেঁদে ফেলবে। সায়রা অবাক হলো। ঈদের দিনেও মেয়েটার গায়ে জামা নেই, মুখে হাসি নেই।
‘আম্মু! আব্বু!’ চিৎকার করে ওঠে সায়রা।
‘কী হলো আবার?’ দৌড়ে এলেন আম্মু।
‘আচ্ছা আম্মু, ওই মেয়েটার গায়ে জামা নেই কেন? আজকে ঈদের দিন না? ঈদে তো সবাই নতুন জামা পরে। আর ও কাঁদছে কেন? ঈদের দিন কেউ কাঁদে? ঈদ মানে তো আনন্দ। ’ বলল সায়রা।
আম্মু সায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘সায়রা, তোমার মতো সবাই ঈদের জন্য অনেকগুলো নতুন জামা কিনতে পারে না। নতুন কেন, অনেকে তো পুরনো জামাও পায় না। তাদের কী কষ্ট হয় না বলো? ঈদ তো ওদের জন্যও। ওদেরও তো ইচ্ছে হয় ঈদের দিন নতুন জামা পরে আনন্দ করতে। শুধু তাই নয়, এই মেয়েটা হয়তো তবুও ঈদের দিন আনন্দে থাকত। কিন্তু তুমি তার আনন্দটুকু কেড়ে নিয়েছ। তুমি ওর কাছ থেকে ওর প্রিয় বন্ধুকে কেড়ে নিয়েছ। ও কীভাবে হাসবে? ও কীভাবে ঈদের আনন্দ করবে বলো?’
এরই মধ্যে আব্বুও সায়রার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ সায়রা। তুমি কিন্তু মোটেই ঠিক কাজ করো নি। ’
সায়রা বুঝতে পারল সে কত বড় একটা ভুল করেছে। খুব কান্না পেল তার। সে বিড়ালটাকে খাঁচা থেকে বের করে কোলে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর কোলে বিড়াল আর এক হাতে নিজের জন্য কেনা ঈদের নতুন একটা জামা নিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে এল সায়রা। আব্বু-আম্মুকে না বলেই দৌড়ে নিচে চলে গেল। সেই মেয়েটা তখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সায়রা ওর কাছে গিয়ে প্রথমেই বিড়ালটাকে ওর কোলে তুলে দিল। এরপর ওর হাতে দিল নতুন জামাটা। বলল, ‘আমি খুব ভুল করেছিলাম। আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। তাই আমি তোমার কাছে তোমার বন্ধুকে ফিরিয়ে দিলাম। আর এই জামাটা আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য ঈদ উপহার। চলো, আজকে থেকে আমরা বন্ধু হলাম। আজকে আমরা মিলেমিশে ঈদের আনন্দ করব। ’
মেয়েটা হেসে ফেলল। তার চোখে জল, মুখে হাসি। সায়রারও তাই। এই কান্না, এই হাসির কোনো পার্থক্য নেই। এটা শুধুই আনন্দের অশ্রু, আনন্দের হাসি। সায়রা ভাবল, এভাবেই হিংসা-বিদ্বেষ, ভেদাভেদ ভুলে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবে ঈদের আনন্দ।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪