বডি মামুনের বাড়ি চারপাশ থেকে দেয়ালে ঘেরা। একেবারে চীনের প্রাচীরের মতো দেয়াল।
‘ও ড-ড-ডঙ্কু, কী-কী-কী করিস?
‘আলো খাই; সূর্যের বেগুনি আলো। তুই খাবি?
‘ন্-ন্-না, তুই খা। আমি আলু খাব। যাই, বাড়ি যাই। ’
এই বলে হাঁটা ধরে মাসুদ। ও, মাসুদের কথা তো বলা হয়নি। মাসুদ ডঙ্কুর ক্লোজ ফ্রেন্ড। কথা বলার সময় একটু তোতলানো স্বভাব তার। আর বাঁ চোখটা একটু ট্যারা। তাই পোলাপাইন তাকে ট্যারা মাসুদ বলে খেপায়।
এই নামে মাসুদ আগে খেপলেও এখন আর খ্যাপে না। সে এটাকেই তার নাম ধরে নিয়েছে। তো মাসুদ বাড়ির পথ ধরে আর ডঙ্কু ঢক ঢক করে সূর্যের আলো খায়। হঠাৎ তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ইপসি। আলো খাওয়া বন্ধ করে ডঙ্কুও তাকে জড়িয়ে ধরে। ইপসিদের আনতে মণি কাকুর সঙ্গে ঢাকায় এয়ার পোর্টে যাওয়ার জন্যই গত কাল থেকে মন খারাপ তার। সেই মন খারাপের জের ধরেই এই আলো খাওয়া-খাওয়ি! তবু ইপসিকে দেখে ভালো লাগে তার। ভুলে যায় মন খারাপের কথা!
কখন আসছ? কাকু আর কাকিমা আসছে? এসব জিজ্ঞেস করে ডঙ্কু। তারপর দেয়াল থেকে নেমে বাসায় গিয়ে কাকু আর কাকিমাকে সালাম করে।
ডঙ্কুর চাচাতো ভাই ইপসি এই প্রথম বাবা-মার সঙ্গে বিদেশ থেকে ঈদ করতে দেশের বাড়ি এসেছে। তারা থাকে মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে। সেখানকার একটা বাঙালি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে ইপসি। বাংলাদেশে জন্ম হলেও সেই এইটুকুন বয়সেই চলে যায় মালয়েশিয়ায়। আর আসা হয়নি। ডঙ্কু আর জেঠিমার সঙ্গে মালয়েশিয়ায় বসে স্কাইপিতে নিয়মিত কথা হলেও কখনও কথা হয়নি জেঠুর সঙ্গে। ছোটবেলায় জেঠুকে যে দেখেছে সেটাও মনে পড়ে না তার। তা ছাড়া জেঠুর বাড়িতে ঢোকার আগেই একটা ওভার ট্রেকিং পায় তারা। আর সেই ওভার ট্রেকিংয়ের পাশেই একটা সাইনবোর্ড খাড়া করানো। যাতে লেখাÑ থামুন; সামনে বডি মামুনের বাড়ি!
ইপসি লেখাটা দেখে কিছুটা ভয়ও পায়। না জানি তার জেঠুর বডিতে কত ধার! বডি মামুন লেখাটা পড়তেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জিমের বডি বিল্ডারদের ছবি! মালয়েশিয়া বিভিন্ন জিমের সামনে ইয়াব্বড় পেশিওয়ালা লোকদের ছবি টাঙানো থাকে। সে ভাবে, তার জেঠু নিশ্চয়ই ওদের মতো হবে। আবার ভাবে, না জানি জেঠু জাপানি সুমো কুস্তিগীরদের মতো! এসব ভাবতে ভাবতে সে ড্রেস চেঞ্জ করার কথা ভুলে যায়। জেঠিমা ডেকে তাকে বুকে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। তার তো দাদা-দাদু নেই। থাকলে তারাও হয়তো তাকে বুকে জড়িয়ে রাখত। কপালে-মুখে আদর করত। তো জেঠিমা তাকে আদর করে চুলে বিলি কেটে দেয়। ইপসি চুপ করে জেঠিমার কোলে লেগে থাকে। আর ভাবে জেঠুর কথা।
বিকেলে ডঙ্কুর সঙ্গে সে রেল লাইনের রেলিং ধরে হাঁটে। একটু আগাতেই রেল লাইন কেঁপে ওঠার আভাস পায় পায়ে। তারপর দু’জনে রেল লাইনে কান পাতে। একি, রেল লাইনে সমুদ্রের গর্জন! রেল যত কাছে আসে ততই যেন সমুদ্রের তর্জন-গর্জন বাড়ে। এক সময় ধুলো উড়িয়ে তাদের পাশ দিয়ে চলে যায় রেল। ফের রেল লাইনে হাঁটে দু’জন। হাঁটতে হাঁটতে যায় হরিনারায়ণপুর রেল স্টেশনে। স্টেশন পেরোলেই হরিনারায়ণপুর বাজার। দুপুর থেকেই বাজারে নদীর মাছ আসতে থাকে। রাজ্যের মানুষ এখানে মাছ কিনতে আসে। রমজানে বাজারটা একটু আগেই শুরু হয়। তা ছাড়া ঈদের বাকি মাত্র দু’দিন।
শহর থেকে যারা বাড়ি এসেছে তারাও ভিড় করছে বাজারে। অনেকে ঈদের বাজারও করে নিচ্ছে। এমন ভিড় দেখে তারা বাজারের উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করল। একটু এগোতেই হ্যাংলা পাতলা একটা লোক ইপসিকে বলা-কওয়া ছাড়াই কোলে তুলে নিল। ইপসিকে কোলে নেওয়ায় লোকটার শরীর কাঁপা শুরু করল। পড়ি পড়ি করছে ইপসি। তবু নামাচ্ছে না লোকটা। ইপসি বুঝতেও পারছে না কিছু। লোকটা তাকে আদর করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। আর ছোট করে বলল, কতদিন পরে এলে বাবা। এবার আর জেঠু তোমাকে যেতে দেব না।
রাস্তার পাশের একটা দোকানের সাইনবোর্ডে তখন ইপসির চোখ আঁটকে যায়। যাতে লেখাÑ
ডঙ্কু মেকানিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়াক্স
প্রোপাইটারÑ বোরহান উদ্দিন মামুন (বডি মামুন)
সে দেখে, দোকানের সামনে বড় একটা বাসের বডি বানানো হচ্ছে। আরেকটা বাসে রঙ করছে। আর বাসটার পেছনে নেম প্লেটেরে মতো ছোট একটা প্লেটে লেখা; বডি-মামুন, ফোন-০১৭১১...।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৪