সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। আগামীকাল ঈদ।
বাসে পা রাখার জায়গা নেই। কোনো রকমে বড় ব্যাগটা সিটের নিচে রেখে অন্যটা কাঁধে ঝুলিয়ে উপরের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। গেটলক বাস চলতে শুরু করলেও জায়গায় জায়গায় থেমে আরও লোক উঠাতে থাকে। আরিচা পাড় হতে হতে রাত একটা বেজে যায়। ফরিদপুরের কাছাকাছি এসে পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী কাঁচা পাকা দাড়িওয়ালা এক লোক তার কাঁধে মাথা রাখে। জাহিদ খানিকটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে
চাচা মিয়া সমস্যা কি?
মধ্যবয়সী লোকটা বলে ওঠেন, বাজান খুব মাথা ঘুরাইতেছে আর পেট গুলিয়ে বমি আসতেছে।
জাহিদ তাড়াতাড়ি জানালার পাশের সিটে বসে থাকা এক যাত্রীকে অনুরোধ করে লোকটাকে ধরে নিয়ে জানালার পাশে বসায়। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বমি করা শুরু করে। সে তার মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখে। বমি করা শেষ হলে জাহিদ তার কাঁধে রাখা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দেয়। সে হাত মুখ ধুইয়ে আবার জাহিদের কাঁধে মাথা রাখে। লোকটাকে দেখে তার খুবই দুর্বল আর ক্লান্ত মনে হয়।
একটু ধাতস্থ হলে জাহিদ লোকটার পরিচয় জানতে চায়। লোকটা বলে বাজান আমার নাম হাশেম আলী। বাড়ি ঝিনেদা। গ্রামের বাজারে রিকশা চালাই। সপ্তাহ দুই আগে ঢাকায় গেছিলাম রিকশা চালিয়ে কিছু বাড়তি আয়ের আশায়। আজ দুপুর দুইটা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটা করে এই বাসে করে বাড়ি ফিরছিলাম। সারাটা পথ দাড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে বমি আসছিলো। তুমি আমার বড়ই উপকার করলে বাজান। তারপর তার ব্যাগের খোঁজে পাশের ছিটের নিচে হাত রাখল। আগের জায়গায় ব্যাগ না পেয়ে সে চিৎকার করে মূর্ছা গেল।
জাহিদ অন্য যাত্রীদের সহায়তায় তার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো। তারপর সে বিলাপের সুরে বলে উঠলো, স্ত্রী, ছেলেমেয়ের ঈদের কাপড় আর বাজার সদাই সব কিছুই ওই ব্যাগে ছিল। দু’সপ্তাহে যা আয় করেছিলাম তা সব গেছে বাজান। এই বলে আবার সে কান্নায় ভেঙে পড়লো। জাহিদ তার নিজের ব্যাগটা ছিটের নিচে খুঁজতে গিয়ে দেখে তারটাও নেই। তার ব্যাগে নিজের কিছু জামা কাপড়, মুরাদ আর তার ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদের নতুন জামা কাপড় আর খেলনা ছিল। সারা বাস তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না। বাসের সব যাত্রীরা তাদের চুরি যাওয়া ব্যাগের জন্য আফসোস করতে লাগলো।
জাহিদ মনে মনে ভাবল ভাগ্যিস তার ঈদ করতে যাওয়ার খবরটা মুরাদকে জানায়নি। সে আসলে ঈদের সকালে মুরাদদের বাসায় পৌঁছে সবাইকে চমকে দিতে চেয়েছিল। এখন এই খালি হাতে তাদের বাসায় যাওয়ার আর কোন মানে হয়না। এরকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাস ঝিনেদা বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছল। হাশেম আলী এলোমেলো পায়ে বাস থেকে নামার চেষ্টা করছে। বেচারার জন্য তার খুব মায়া হলো। সে তাকে ধরে বাস থেকে নামালো। হাশেম আলী অবাক চোখে বললো
বাজান তুমি নাইম্যা পড়লা যে?
চলেন চাচাজি আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।
মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে। তারা দুজন একটা রিকশা ভ্যানে উঠে বসলো। তখনও হাশেম আলীর শরীর কাঁপছে। জাহিদ পরম মমতায় তাকে ধরে রাখল। ভ্যান বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই হাশেম আলীর মেয়ে আর দুই ছেলে বেড়িয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। হাশেম আলীর মেয়ে রুমা স্থানীয় কলেজে বিএ পড়ে। আর ছেলে দুটো হাইস্কুলে পড়ে। তার স্ত্রী বড় ঘোমটা মাথায় দাওয়ার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো।
হাশেম আলী জাহিদকে নিয়ে এসে দাওয়ায় পাতা মাদুরে বসলো। তারপর কান্না জড়িত কণ্ঠে বাসের সব ঘটনা খুলে বললে পরিবারের সবাই তাকে আশ্বস্ত করলো।
কিছুক্ষণ পরে সবার নজরে পড়লো যে জাহিদের জামার পকেটসহ বেশ খানিকটা ছিঁড়ে ঝুলে আছে। বাসে যে ব্যাগটা চুরি গেছে তাতে জাহিদের জামা কাপড় ছিল। হাশেম আলীর পরিবারের সবাই অসহায়ের মতো জাহিদের ছেঁড়া জামার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে রুমা একটি নতুন পাঞ্জাবির প্যাকেট জাহিদের হাতে দিয়ে বললো, আমার টিউশনির টাকা দিয়ে বাজানের জন্য ঈদের নতুন পাঞ্জাবি কিনে রেখেছিলাম। আপনি এটা পড়ে ঈদের নামাজে যেতে পারবেন।
জাহিদ হঠাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। তাকিয়ে দেখল পরিবারের সবাই রুমার অনুরোধ নীরবে সমর্থন করছে। তারপর সে হাশেম আলীকে অনুসরণ করে পুকুর থেকে গোসল সেরে নতুন পাঞ্জাবি পড়ে গ্রামের বড় মাঠে একসাথে ঈদের নামাজ পড়তে গেল।
নামাজ শেষে তারা বাজার থেকে সেমাই, চাল মাংস আর ছোট দুই ছেলের জন্য জামা কিনে বাড়ি ফিরলো। রুমার মা তাড়াতাড়ি করে ঈদের রান্না চাপিয়ে দিলো আর মেয়েটা তাতে হাত লাগালো। দু’ভাই নতুন জামা পরে মনের আনন্দে উঠানে খেলা করছে। হাশেম আলী আর জাহিদ দাওয়ায় বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কি ভেবে যেন জাহিদ তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা খুললো। মনে পড়লো গতকাল মুরাদদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করার সময় তার স্ত্রীর জন্য কেনা শাড়িটা হাতের ব্যাগে জায়গা না হাওয়ায় কাঁধের ব্যাগে রেখেছিল। শাড়িটা বের করে সে রুমার জন্য হাশেম আলীর হাতে তুলে দিলো।
দুপুরে রান্না শেষ হলে সবাই মিলে গোল হয়ে দাওয়ায় মাদুর পেতে খেতে বসলো। জাহিদ অবাক বিস্ময়ে দেখল রুমা গোসল করে ভেজা চুলে তার দেওয়া শাড়িটা পড়েছে। ফোঁটায় ফোঁটায় পানি তার চুল থেকে পড়ে শাড়ির আচল ভিজিয়ে দিয়েছে। রান্না ঘরের পেছনের ঝোপ থেকে ভেজা বাতাসে ভেসে আসছে কাঁঠালিচাঁপার মধুময় গন্ধ। রুমা জাহিদের পাতে খানিকটা পোলাও তুলে দিতে দিতে বললো কই ভাইজান বললেন না তো মার রান্না কেমন হয়েছে? মার রান্নার কিন্তু আমাদের গ্রামে খুব সুনাম আছে।
জাহিদ প্লেট থেকে মুখ তুলে বললো আমার সারা জীবন কেটেছে হোস্টেল আর রেস্টুরেন্টর রান্না খেয়ে। কবে সেই ছোটবেলায় মার রান্না খেয়েছি মনে পড়ে না। তবে চাচির হাতের রান্না মার রান্নার কথা মনে করিয়ে দেয়। কথাগুলো বলতে পেরে জাহিদের বুকটা হালকা হয়ে চোখটা ছলছল করে ওঠে। খাওয়া দাওয়া শেষে রুমার সাজানো মিষ্টি পান খেতে খেতে সে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথাটা পাড়ে। সবাই এক বাক্যে প্রতিবাদ করে। সবশেষে সিদ্ধান্ত হয় রাতের গাড়িতে সে ঢাকা ফিরে যাবে।
কথায় কথায় সে হাশেম আলীর কাছে জানতে পারলো তার মেয়ে রুমা ক্লাসের মেধাবী ছাত্রী ছাড়াও ভালো গাইতে পারে। স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমিতে সে বিনা বেতনে গান শিখেছে। পড়ন্ত বিকেলে পাশের বাড়ি থেকে হারমোনিয়াম ধার করে এনে সে বেশ কয়েকটি গান গাইলো। সামিনা চৌধুরীর একটি গান জাহিদকে রীতিমতো অবাক করে দিলো কে দিলো জাদুর দুপুর, কে দিলো সোনার বিকাল, কে দিলো সোহাগ রাতি, কে দিলো অলস সকাল, এমন মধুর এমন মধুর.........
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। জাহিদ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাশেম আলীকে সঙ্গে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলো। বাসে ওঠার পর হঠাৎ করে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। হাশেম আলীর দরিদ্র পরিবারকে তার খুব কাছের বলে মনে হলো। কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে মানুষ মানুষের এত কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে তা আগে কখনো ভাবতে পারেনি। বাসের ঝাঁকুনি আর গতরাত জাগার ক্লান্তিতে তার চোখে তন্দ্রার মতো এলো। আধো ঘুম আধো জাগরণে সে শুনতে পেল সন্ধ্যায় গাওয়া রুমার গানটা
তোমায় কে শেখালো বাসতে ভালো বলতে পারো, দুঃখের নদী বুকের ভেতর কে লুকালো.........
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৪