তার নাম বুলগি। বিশাল হাঁ আর ভয়ঙ্কর লেজ নিয়ে ছুটে বেড়ায় নীল সমুদ্রে।
বড় হতে না-হতেই বুলগির দেহ হয়ে উঠলো ৯০ ফুট লম্বা আর ২৫ ফুট চওড়া। আর ওজন? তিন-তিনটি দোতলা বাসের সমান। এই বিশাল দৈত্য যদি দুষ্টুমি করে, কার না বিপদ, বলো?
তো বুলগির অত্যাচার যখন খুবই বেড়ে গেল, তখন দরিয়ার সব সওদাগর গেল সিন্দাবাদের কাছে। সিন্দাবাদকে তো সবাই চেনো, তাই না? সেই যে বাগদাদের বিখ্যাত সওদাগর। জীবন বাজি রেখে সাত সাত-বার অচেনা সাগরে জাহাজ ভাসিয়েছেন যিনি। কখনো তার জাহাজ ভেঙেছে ভয়ঙ্কর ঝড়ে, কখনো গিয়ে পড়েছেন একচোখা দৈত্যের কবলে। কখনো দ্বীপ ভেবে ভুল করে পা রেখেছেন বিশাল তিমির পিঠে, কখনো লড়াই করেছেন রক-পাখির বিরুদ্ধে। সাহস, দৃঢ়তা, বুদ্ধি আর আল্লার ওপর বিশ্বাস রেখে প্রতিবারই ফিরেছেন বেশুমার দৌলত নিয়ে। খ্যাতি যার জগৎজোড়া, আর হৃদয়ও দয়ার সাগর।
সওদাগরদের কাছে বুলগির কথা শুনে তিনি হেসে বললেন, ও দেখি আমার মতই সাহসী। ‘তার মানে?’— সবাই বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চায়। মানে কিছু না। বৃদ্ধ সিন্দাবাদ দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন: আমি যখন কেবল জোয়ান হয়েছি, আমারও অমন পাগলামীর ইচ্ছে হতো। খোঁজ নিয়ে দেখো, বুলগির কোনো কাজ নেই। তার অত শক্তি কাজে লাগছে না বলেই সে অত দুষ্টু! ‘এসব জেনে আমাদের কী হবে, সিন্দাবাদ?’— অবাক কণ্ঠে সওদাগররা বলে, ‘আমাদের দরকার নিরাপত্তা। নিরাপদে বাণিজ্য করা। জাহাজই যদি চালাতে না পারি, ব্যবসা হবে কিভাবে?’ ঠিক। চিন্তিত মুখে জবাব দেন সিন্দাবাদ। তো বলো, কী চাও তোমরা আমার কাছে?
আপনার বুদ্ধি দিয়ে আমাদের সাহায্য করুন।
অন্যের বুদ্ধি নিয়ে কি কারো লাভ হয়, ভাইয়েরা? তোমরা নিজেরা কিছু করার চেষ্টা করছো না কেন?
আমাদের মাথা কাজ করছে না, সিন্দাবাদ। আর ভয়ও পাচ্ছি খুব।
ঠিক আছে, তোমরা আমাকে হপ্তা খানেক ভাবতে দাও। আমি কোনো উপায় বাতলে দেবো।
সওদাগররা খুশি হয়ে বললো, এক হপ্তা নয়, আপনাকে পুরো এক মাহিনা সময় দিলাম,
সর্দার। আপনি আলো দেখান।
দেখি, আল্লাহ সাহায্য করেন কিনা!
দুই.
সিন্দাবাদ সওদাগর সেদিন রাত্রেই তার জাহাজ ভাসালেন সাগরে। তিনদিন চার-রাত্রি চলার পর মাস্তুল-নাবিক চিৎকার করে জানালো: ঐ যে দূরে দেখুন, সিন্দাবাদ। বিরাট হাঙরের ফিন দেখা যাচ্ছে। ডান থেকে বামে যাচ্ছে রকেটের গতিতে। ওটাই হয়তো বুলগি হবে। সাবধান!
সিন্দাবাদ আগেই বুদ্ধি করে লোহার-শিক দিয়ে বিরাট এক ছাগল ছানা বানিয়ে রেখেছিলেন। বাইরেটা তার গরু-মহিষ-উটের মাংস পেচানো। লোভী হাঙর এটা খেতে আসবেই। বুলগিও এলো। তার ভয়ংকর লেজের ঝাপটায় উল্টে যেতে চায় সিন্দাবাদের বিশাল ময়ুরপঙ্খী। কিন্তু চালাক-সওদাগর জাহাজ বাঁচাবার জন্য আগেই দু’দিকে শোলা-ভর্তি বিশাল-বিশাল সিলিন্ডার আটকে নিয়েছিলেন।
ক্রুদ্ধ বুলগি জাহাজ ভাঙতে না পেরে দু’তিনবার লাফিয়ে উঠলো পানির উপর। সে-কি ভয়ঙ্কর তার চেহারা। করাতের মতো দাঁতগুলোর ফাঁকে বুঝি সারেঙের মস্ত কেবিনটাই ঢুকে যায় আর কি! রাগে যখন বুলগির বুদ্ধিসুদ্ধি ঝাপসা হয়ে এসেছে প্রায়, তখনই সিন্দাবাদ ক্রেন দিয়ে মাংসের বিশাল-ছানাটিকে পানিতে নামালেন। তাজা মাংসের গন্ধ আর রক্তের স্বাদ বুলগিকে অন্ধ করে দিলো। ধনুকের মতো বাঁকা পথ ধরে সে তীরবেগে ছুটে এলো টোপ-এর দিকে। দুষ্টু বুলগি ভেবেছিল ছাগল ছানাটিকে এক কামড়েই দফা-রফা করে ছাড়বে। কিন্তু তা করতে না পেরে সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে দ্বিতীয়বার সর্বশক্তি দিয়ে কামড় মারলো। তখনই চতুর সিন্দাবাদের কৌশলের কাছে পরাজিত হলো দুষ্টু হাঙর। ছাগল-ছানার মাংসের ভেতরে পোতা শক্ত লোহার শিকে বেঁধে কটকট করে ভেঙে গেল তার তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি। মহা-শক্তিশালী দানব মুহূর্তেই হয়ে গেল ফোঁকলা-বুলগি!
তিন.
সপ্তম-দিন আগের মতই মেহমানখানায় বসেছেন সিন্দাবাদ। সওদাগররা সবাই হাজির হয়ে জানতে চাইলেন: বুলগির উৎপাত থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য তিনি কী করলেন? সিন্দাবাদ হাসিমুখে বললেন, আমি বৃদ্ধ মানুষ! কী আর করতে পারি, বলো? বুড়োরা পারে শুধু দোয়া করতে। বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে তার বুদ্ধি আর আল্লার সাহায্য। তোমরা নিজেরা আরো চেষ্টা করো আর তাঁর কাছে সাহায্য চাও। আমিও চিন্তা করছি।
সওদাগররা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। তারা তো আর সিন্দাবাদের মতো দুঃসাহসী বীর নয়।
কী আর করা। কিছুদিন অপেক্ষা করে ভয়ে ভয়ে আবার তারা জাহাজ ভাসালো দরিয়ায়। ফিরেও এলো নিরাপদে। বুলগির আর পাত্তা নেই। সিন্দাবাদ তাদের আনন্দিত মুখ দেখে হাসেন আর বুলগির জন্য মাঝে মাঝে সত্যিকার ছাগলছানা পাঠান নিজের জাহাজে করে। ফোঁকলা-বুড়িকে খেতে হবে তো!
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৪