পৃথিবীর আধুনিক ইতিহাসকে যেমন নানা যুগে ভাগ করা হয়েছে, পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক সময়কেও তেমনি ভাগ করা হয়েছে কয়েকটি ভূ-তাত্ত্বিক যুগে। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে প্রায় ১৪ কোটি ও ২১ কোটি সময়সীমার মধ্যে পৃথিবীতে ছিল জুরাসিক যুগ।
জুরাসিক নামটি এসেছে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের জুরা পর্বতমালা থেকে। কারণ, এখানে জুরাসিক যুগের পাথর পাওয়া গেছে প্রচুর পরিমাণে। পৃথিবীর ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাসে এই যুগটি ছিল সরীসৃপের যুগ। এই যুগেই পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াতো দৈত্যকার ডাইনোসর।
সে সময় ছিল না বনমানুষ, ছিল না সিংহ কিংবা হাতি। তখন পৃথিবীতে ছিল সাপ, কুমির, সামুদ্রিক সরীসৃপ, নানারকম মাছ অমেরুদন্ডী প্রাণী ইত্যাদি। পৃথিবীতে তখনো তিমি জন্ম নেয়নি। তবে পেসিয়োসর ও ইকথিয়োসর নামে দুই সামুদ্রিক সরীসৃপ তিমির মতো সারা সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াতো। এ দুটি প্রাণী ছিল সরীসৃপ জাতীয়। তাই এরা ডিম পাড়তো কিন্তু বাচ্চার জন্ম দিতো না।
পৃথিবীতে প্রথম পাখির দেখা মেলে এ যুগেই, আশ্চর্য পাখির নাম ‘আর্কিয়োপটেরিক্স’। শব্দ ভেঙে অর্থ করলে দাঁড়ায়- ‘আর্কিয়ো’ কথার মানে প্রাচীন আর ‘টেরিক্স’ শব্দের অর্থ পাখা। প্রথম পাখিটির ফসিল পাওয়া গেছে দক্ষিণ জার্মানির ব্যাভেরিয়ায়। চুনা পাথরের মধ্যে। আর্কিয়োপটেরিক্সের আকার তেমন বড়ো ছিলো না। কাকের চেয়েও সামান্য বড় তবে শরীর ছিল শক্তপোক্ত। তাছাড়া লম্বা মাথার সামনের দিকটা সরু হয়ে ঠোঁটের আকার নিয়েছিলো। সেই ঠোঁটের মধ্যে ছিল বেশ কয়েকটা দাঁত।
এ যুগের পাখির অবশ্য দাঁত নেই। তাই লম্বা শক্ত লেজ থেকে ডাইনোসরের সঙ্গে আর্কিয়োপটেরিক্সের আত্মীয়তা বোঝা যায়। আকাশে তখন শুধু যে আর্কিয়োপটেরিক্সের দেখা মিলতো তা কিন্তু নয়। আকাশের অনেকটা জায়গাই দখল করে থাকতো টেরোস নামের এক ধরনের উড়ন্ত টিকটিকি। তবে এদের চেহারা ও ভাবসাব ছিলো বিদঘুটে বাদুরের মতোই। লম্বায় এরা বিশ ফুট ছাড়িয়ে যেতো। জুরাসিক যুগে পৃথিবীর আবহাওয়া ছিলো মৃদু ঠান্ডা। তাই সে সময় মেরু অঞ্চলেও ভরে উঠেছিলো প্রচুর গাছপালায়। এ সময় যে গাছ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জন্মাতো তার মধ্যে বলতে ফার্ন সাইকোড, জিংকগো, কনিফার ইত্যাদি গাছের নাম উল্লেখযোগ্য।
জিংকগো গাছগুলো যথেষ্ঠ লম্বা হতো। প্রায় তিন ফুট ব্যাসের এই গাছগুলো লম্বায় হতো ৭৫-৮০ ফুট। জুরাসিক যুগে সমুদ্রে নানা ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণীও ছিল। যেমন শামুকের মতো অ্যামোনাইট বেলেমনাইট ইত্যাদি সমুদ্রের তলদেশে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতো। এছাড়া সে যুগের সমুদ্রে ছিল অগুণতি নানা ধরনের কাঁটাওয়ালা মাছও হাঙর। তাছাড়া বেশ কিছু সাঁতারু টিকটিকি। যেমন- পেসিয়োসর ও ইকথিয়োসর। এদের কথা তো আগে বলাই হয়েছে। এ যুগেই পৃথিবীতে প্রথম ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শোনা যায়।
জুরাসিক যুগে ডাইনোসর ছিলো বেশ কয়েক ধরনের। তবে দু ধরনের নাম জানতে পারা যায়। সরিসিয়া ও অর্নিথিসিয়া। সরিসিয়া ধরনের ডাইনোসরের আকার ছিলো বিরাট। তবে খাবার অভ্যেসের দিক দিয়ে কেউ কেউ মাংসাশী আবার কেউবা নিরামিষাশী। ফলে ফলমুল খেয়েই দিন কাটাতো। উল্লেখ্য, এই দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ডাইনোসরের নাম টিরানোসরাস। প্রায় পঞ্চাশ ফুট ( ১৬ মিটার ) লম্বা এই ডাইনোসর মাটির ওপর দাঁড়ালে উচ্চতা হতো প্রায় কুঁড়ি ফুট। বিরাট মাথাওয়ালা মাংসাশী এই ডাইনোসরের মুখের হা ছিলো বিশাল, যা দেখলে ভয় পেতো না, এমন কোনো প্রাণী ছিলোনা সে যুগে।
সে যুগের আরেক দৈত্যকার ডাইনোসরের নাম ব্রন্টোসরাস। এটি লম্বায় টিরানোসরাসের চেয়েও বড় ছিলো (প্রায় ৭০ ফুট) তবে শ্লথ গতির এই ডাইনোসরটি ছিল নেহাতই নিরামিষাশী। আর তেমন লড়াকু স্বভাবের নয়। জুরাসিক যুগে গিরগিটিদের রমরমা থাকলেও স্তন্যপায়ীরাও জন্ম নিয়েছে। তবে সংখ্যায় কম, আকারে ছোট।
স্তন্যপায়ী হলেও কোনো কোনো প্রাণী ডিম পাড়তো। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। আবার সে যুগে সরীসৃপ হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো ডাইনোসরের বাচ্চা হতো। তবে ডাইনোসরের ডিম পাওয়া গেছে স্তরীভূত পাথরের মধ্যে।
ভূ বিজ্ঞানীদের ধারণা, জুরাসিক যুগের শেষ দিকে আকাশ থেকে পৃথিবীর বুকে খসে পড়েছিলো এক বিরাট উল্কা। সেই বিরাট উল্কার সঙ্গে সংঘর্ষে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হলো বিরাট ফাটল। আর আকাশ বাতাস চারদিক এত ধুলোয় ঢেকে গেল যে, সূর্যের মুখ দেখাই কঠিন হয়ে পড়লো। আর অন্যদিকে বিরাট ফাটল ধরে পৃথিবীর বুক থেকে বেরিয়ে এলো প্রচুর লাভা গ্যাস আর ছাই। সেই প্রতিকুল পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে সদলবলে হারিয়ে গেলো ডাইনোসররা। সমাপ্তি ঘটলো জুরাসিক যুগের পৃথিবীর।
লেখক: মঈনুল হক চৌধুরী, সম্পাদক, কিশোর সাময়িকী ও ঢাকা সাময়িকী।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৪