২৫ মার্চ মধ্যরাত, ১৯৭১। অন্য সব রাত থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই রাতটি একটু আলাদা।
দেশজুড়ে সে সময় চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। সবার মুখে কেবল একটিই স্লোগান ‘পদ্মা যমুনা মেঘনা, তোমার আমার ঠিকানা’ এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ’
‘অপারেশন সার্চলাইটের’ মূল লক্ষ্য ছিল পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, নিউমার্কেট, ঠাটারি বাজার, পুরান ঢাকা, ফরাশগঞ্জ, বিকে দাস লেন, শাঁখারী বাজার, তাঁতী বাজার, ভোলা গিরি আশ্রম, অভয়দাশ লেন, টিকাটুলি, হাটখোলা, আরকে মিশন রোড, গেণ্ডারিয়া সাধনা ঔষধালয়সহ বিভিন্ন এলাকা। সংবাদপত্র অফিসের মধ্যে লক্ষ্য ছিল ‘পিপলস অফিস, ইত্তেফাক ও সংবাদ। ’ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সে রাতে পাকিস্তানিরা কমপক্ষে ১০ হাজার সাধারণ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। যার মধ্যে ছিল রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনের ৫ শতাধিক পুলিশ ও ৩ শতাধিক নিরীহ শিক্ষার্থী।
মধ্যরাতে পাকি ট্যাঙ্কগুলো কামান উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সঙ্গে লরি বোঝাই সৈন্য। প্রথমে তারা গুলি চালায় ইকবাল হলে। এতে মারা যান শতাধিক ছাত্র। এরপর জগন্নাথ হলে ঢুকে সাব-মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করে আরও দেড় শতাধিক ছাত্র-শিক্ষককে। রোকেয়া হলও আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি। গুলি চালিয়ে তারা হত্যা করে অনেক ছাত্রীকে। কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায়। মেডিকেল কলেজ এবং হোস্টেলেও গুলি করে অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে হায়েনার দল।
এসব ঘটনা যখন ঘটছিল, তখন সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিট শেখ মুজিবের বাড়ি ঘিরে ফেলে। রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাঙ্ক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য শেখ মুজিবের বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে। তারা বাসার সামনে আসার পর একজন অফিসার ইংরেজিতে বলেন, ‘শেখ, আপনি নেমে আসুন। ’ শেখ মুজিব তার বেলকনিতে বেরিয়ে এসে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত; তবে গুলি ছোঁড়ার দরকার ছিল না। আপনারা আমাকে টেলিফোন করে তারপর আসতে পারতেন। ’ এরপর অফিসারটি ভেতরে ঢুকে শেখ মুজিবকে বললেন, ‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। ’
ভোর ৫টার পর পাকিবাহিনী গোলার আঘাতে উড়িয়ে দেয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা যেন এক নিস্তব্ধ নগরীতে রূপ নেয়। চারিদিকে শুধু চলতে থাকে লাশ আর স্বজনের কান্নার মিছিল।