ঢং ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে। স্কুল ছুটি হয়।
বিন্তির মা নেই। সে জানে তার জন্য গেটে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না। তাই সবাই চলে যাওয়ার পর সে একা একা স্কুল গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার মন থাকে দু:খে ভরা।
বিন্তির মা থাকতে প্রতিদিন তাকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। স্কুল ছুটি হলে তাকে আবার নিয়ে আসতেন বাসায়। ছুটি হওয়ার আগেই মা তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন গেটে। সেও এক দৌঁড়ে মায়ের কোলে গিয়ে পড়ত। মা তাকে দেখে প্রায়ই বলতেন, খুব খিদে পেয়েছে বুঝি, মুখটা এতো শুকনা লাগছে কেন মা? এ কথা বলেই মা কোন না কোন খাবার দিতেন তার মুখে। সে মজা করে খেত। তারপর রিকশা করে মায়ের সাথে চলে যেত বাসায়। রিকশা থেকে যাতে না পড়ে যায় সে জন্য মা তার সামনে হাত দিয়ে ধরে রাখতেন। রিকশা ধাক্কা খেলে মা তাকে জড়িয়ে ধরতেন আর চোখ বড় করে বলতেন, এখনই তো পড়ে মরতি। মা তাকে খুব সাবধানে নিয়ে আসতেন বাসায়।
স্কুলে আসা যাওয়ার সময় সে মায়ের সাথে অনেক গল্প করত। হাসি তামাশা করত। মা তার গল্প শুনতেন আর বলতেন মুখের খাবারটা আগে খেয়ে নে তো, এত কটকট করিস না। সে তবুও কথা বলত মায়ের সাথে। মায়ের সাথে অনেক দুষ্টুমিও করত। মা কখনো রাগ করতেন না। মা তার মাথার চুল গুছিয়ে দিতেন। আদর করে গাল টিপে দিতেন। কপালে চুমু খেতেন। মা ছিলেন তার বন্ধুর মতন।
এখন প্রতিদিন স্কুল গাড়িতে করে বাসায় যায় বিন্তি। গাড়িতে বসে সবাই যখন হৈ চৈ করে। বিন্তি কোন কথা বলে না। একদম চুপচাপ বসে থাকে। মন খারাপ থাকে তার।
বাসায় মা নেই। তাই স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে তার একদম ভালো লাগে না। বাসায় ফেরার সময় মনে মনে বলে, গাড়িটা যদি নষ্ট হয়ে যেতো। না, গাড়িটা নষ্ট হয় না। চলে। আবার বলে, গাড়িটা যদি কোথাও হারিয়ে যেতো। না, হারায় না। ঠিক চলে আসে বাসার গেটে। সে তখন সিড়ি বেয়ে চার তলায় উঠে। কলিং বেলটা টিপ দেয়ার আগে মনে মনে বলে, বেলটা টিপলেই যদি মা এসে দরজাটা খুলতেন। কিন্তু দরজাটা খোলেন তাদের বুয়া ঝরনা। একদিন ঝরনা দরজা খুলে কেমন জানি একটু মুচকি হাসি দিয়েছিল। তখন তার মনটা ধক করে উঠে। মনে হয়েছিল কোন রহস্য আছে। তাকে সারপ্রাইজ দিতে চায় বোধ হয়। সে এক দৌঁড়ে বাথরুম, কিচেন রুম ও বারান্দায় চুপি দিয়ে দেখল মা এসে কোথাও লুকিয়ে আছেন কি না। না পায়নি। তারপর সে দরজার পেছনে, খাটের নিচে, আলনার পেছনে মাকে খোঁজে। না কোথাও মা নেই। তারপর কাঁধের ব্যাগটা রেখে চুপ করে বসে থাকে খাটে। তার শরীররটা অবশ হয়ে যায়। বুয়া তখন তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।
প্রায় চার বছর হলো সে তার মাকে হারিয়েছে। এরপর সে আর মা বলে কাউকে ডাকতে পারেনি। খুব ইচ্ছে করে মা বলে ডাকতে। তাই সে যখন একা থাকে তখন মাকে ডাকে। বাথরুমে গেলেও সে মা, মাগো বলে ডেকে ডেকে অনেক কথা বলে।
ক¤িপউটারে প্রায়ই মায়ের ছবি আঁকে। মাকে চিঠি লিখে। ‘মা তুমি আসোনা কেন? তুমি আমাকে ছাড়া কোথায় থাকো মা? কেমন করে থাকো, তোমাকে কতদিন হয় দেখি না। লক্ষ্মী মা আমার। তোমাকে আমি আর জ্বালাতন করবো না। ঠিক তোমার কথামতো চলব। তোমার জন্য খুব কষ্ট হয় আমার। তুমি চলে এসো। তবুও মা আসে না তার।
সে পরের দিন মনে করে মা বোধ হয় তার চিঠির জবাব দিয়েছেন। ক¤িপউটারটা অন করে খুঁজে। কিন্তু না কোন জবাব আসেনি। তখন সে নিজেই মা হয়ে তার চিঠির জবাব লিখে। পরে চিঠিটা বারবার পড়ে। মনে হয় মা চিঠির জবাব দিয়েছেন। এভাবে সে প্রতিদিন মায়ের কাছে চিঠি লিখে, চিঠির জবাব লিখে আর পড়ে।
মা থাকতে তার ভাইয়া তাকে খুব জ্বালাতন করতো। খাওয়া পড়ায় হিংসা করতো, এটা সেটা নিয়ে রোজ ঝগড়া করতো। মারতো। সেও খামছি দিত, থুতু দিত ভাইয়াকে। এখন ভাইয়া তাকে আর মারে না। আদর করে। স্কুল থেকে আসলেই একটা চকলেট দেয় আর বলে মায়ের জন্য চিন্তা করিস না।
একদিন ভাইয়া তার জন্য একটা বিড়াল ছানা এনে দিয়ে বলে, এই নাও তোমার সঙ্গী। সে বিড়ালছানা পেয়ে তো মহাখুশি। নাম রেখেছে পুশি। পুশি তার ভালো সঙ্গী এবং মিষ্টি বন্ধু।
গত ঈদে সে দাদু বাড়ি যাওয়ার সময় পুশিকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আবার সঙ্গে করে নিয়ে আসে বাসায়। এজন্য গাড়িতে, বাড়িতে, পথে কত লোকের কত কথা যে শুনতে হয়েছে তাকে। কেউ বলেছে ইশ্, শহর থেকে কোলে করে বিড়াল নিয়ে এসেছ, বেটি খামচি দিবে তো। কেউ বলেছে বিড়ালকে এতো আদর করতে নেই, এতে ডিপথেরিয়া রোগ হয়। সে কারো কথাই শুনেনি, ভয়ও পায়নি। সে পুশিকে অনেক আদর করে আর ভালোবাসে। কারণ পুশির সাথে আমার একটা মিল আছে। তার মতো পুশিরও মা নেই।
বিশ্ব মা দিবসে বিন্তি ও তার ভাই শামস স্কুলে যায়নি। ওই দিন ওরা বাসায় বসে খুব করে কেঁদেছিল। তাদের আব্বু অফিস থেকে ফোন করে এ কথা জানতে পারলেন। আব্বু সাথে সাথে ছুটি নিয়ে চলে এলেন বাসায়। আব্বু তাদের জন্য কার্টুন ও গেমসের সিডি নিয়ে এলেন। বিকেলে তাদের নিয়ে শিশু মেলায় গেলেন। সেখানে অনেক মাকে শিশুদের আদর করতে দেখেছে তারা। এসব দেখে তাদের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
সে প্রতিদিন তার মায়ের অপেক্ষায় থাকে।