মায়ের মুখে রাতে ভূতের গল্প শোনার ইচ্ছা ছিলো না রুশোর। কিন্তু মা যখন বললো এটি মামদো ভূতের ছানার গল্প তখন লোভ সামলাতে পারলো না।
মাতো জানতোই, ভূতের গল্প শুনলে ভয় হয়। তাও যে কেনো বললো! যতই হোক মামদো ভূতের ছানা! ভূততো। ভয়তো লাগেই... কেন যে লোভ করতে গেলাম!!
গল্প শেষে এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েও পড়লো রুশো।
বিপত্তি হলো তখন যখন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলো প্রচণ্ড হিসুর চাপে।
বিছানায় শুয়ে শুয়েই রুশো আরও একবার ভাবলো... না রাতে গল্পটি না শুনলেই ভালো হতো। এখন এই মধ্যরাতে কীভাবে যে কর্মটি সারা যায়। চোখ খুলতেই ভয় লাগছে।
মটকা দিয়ে পড়ে থাকলো মিনিট তিনেক। মনে মনে সাহস সঞ্চার করছিলো। হঠাৎ তার মনে পড়লো রাতে মায়ের বুকে শুয়েই গল্প শুনছিলো... কিন্তু এখন বিছানায় সে একা।
দিন কয়েক হয়েছে রুশোকে আলাদা করেছে বাবা-মা। রাতে ঘুমোবার সময় মা তার সঙ্গে শোয় ঠিকই কিন্তু পরের দিকে মাকে আর পাওয়া যায় না। এর আগেও একরাতে রুশো বিষয়টি টের পেয়েছে কিন্তু তা ঘুমের ঘোরে। আজ পাকাপাকি জানা হয়ে গেলে রাতে এখন সে একাই ঘুমায়।
ভাবতে ভাবতে অভিমান বাড়ছিলো। তাতে ভয়টা সামান্য কাটলেও, নিচের দিকের চাপটাও তীব্রতর হয়ে ওঠে।
এবার আর বিছানা না ছাড়লেই নয়। নইলে বিছানাতেই কম্মকাবার হয়ে যাবে। সেটা কম লজ্জার হবে না। ভোরে বড়পা এ নিয়ে হাসাহাসি করবে, কাজের মেয়েটি নাক সিঁটকাবে, কারণ ধৌতকরণ তার দায়িত্বেই পড়বে।
এক ঝটকায় উঠে বসে আবার হতোদ্যম হয়ে বসে রইলো খানিকটা। চোখ তখনও বন্ধ।
এবার চোখ খুলে নামলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বাথরুমের দরজার দিকে। অন্তত একটি কাজ মা ঠিক করে গেছে ভাবলো রুশো। টয়লেটের দরজাটি হালকা খুলে রেখে আলোটি জ্বালিয়ে রেখে গেছে মা।
সুনসান মধ্যরাতে দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা এক চিলতে আলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভরসার মনে হলো রুশোর কাছে। দরজা ধাক্কা দিতেই আলোর ঝলাকানি চোখে লাগলো। এরপর জিপার খোলা, আর কমোডমুখী হয়ে কাজটি শুরু করার জন্য সর্বোচ্চ ৫ সেকেন্ড সময় নিলো সে।
পুরোটা শেষ হতে একটু সময় লাগছে। সন্ধ্যা রাত থেকে জমে থাকা, সময়তো লাগবেই। মনে পড়েছে রাতে শুতে যাওয়ার সময় ভূতের গল্পের টানে আর হিসু করা হয়নি।
কাজটি যখন মাঝামাঝি ততক্ষণে আলো চোখ সওয়া হয়ে গেছে। চোখ খুলে প্রথমেই দৃষ্টি পড়লো টয়লেটের ভেন্টিলেটারে। ছোট্ট শিশু শিশু মুখের একটি ছেলে ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো ছড়িয়ে দিয়ে হাসছে।
রুশো তাকাতেই বললো... বাব্বা ঢের হিসু করলে দেখছি.. তাও ভালো বিছানা ভেজাওনি।
রুশোর ততক্ষণে ভয়ে আত্মা দেহ ছাড়ে ভাব। সজোরে চিৎকার দিয়ে মাকে ডাকতে চেষ্টা করলো। কিন্তু যতো জোরেই ডাকে কণ্ঠ থেকে স্বর আর বেরোয় না।
ততক্ষণে ভেন্টিলেটার থেকে ঝুপ করে খালি বাথটাবটির মধ্যে পড়লো শিশুর মতো দেখতে ছেলেটি। বললো, ভয় পেয়ো না... আমি মামদো ভূতের ছানা।
খেয়াল করে দেখলো এর একটি চোখ কানা। মনে পড়লো রাতে মা গল্পের মাঝেই ছড়া কেটেছিলেন... মামদো ভূতের ছানা... তার একটা চোখ কানা...
রাতে মায়ের দেওয়া মামদো ভূতের বর্ণনা অদ্ভুত মিল রয়েছে এই ভূতটির সঙ্গে। সেই গায়ে হালকা লোম। দেখতে শিশুদের মতো, নাকটা একটু চাপা, সাদা ঝকঝকে দাঁত।
মা বলছিলো ভূতদের নাক একটু চাপা থাকে আর তাই ভূতের কথাগুলো হয় নাকি সুরে।
মামদো ভূতের ছানাটিও নাকি সুরে বলছিলো.. রুঁশোঁ.. ভঁয় পেঁওনা ভঁয় পেঁওনা... আঁমি তোঁমায় কিঁছু কঁরবো না।
নিজের নামটির অদ্ভুত উচ্চারণ শুনে হাসি পেলো রুশোর। সে ফিক করে হেসে দিলো.. শুনে সাদা দাঁতগুলো মেলে ফিক করে হেসে উঠলো মামদো ভূতের ছানাটিও। আর কথা নেই বার্তা নেই, পটাপট গোটা তিনেক ডিগবাজি খেলো।
রুশো বললো এটা কি হলো? ভূত ছানা বললো, খিঁদে পেঁয়েছে তোঁ তাঁই এঁকটুঁ খেঁয়ে নিলাম। ডিগবাজি খেলে তো ক্ষুধা আরও বাড়ে বোকা.. বললো রুশো। ভূত ছানা বললো না.. না.. ডিঁগবাঁজিও তোঁ এঁক ধঁরনের খাঁওয়া। খিঁদে পেঁলে আঁমি ডিঁগবাজি খাঁই।
আবার হেসে ফেললো রুশো। আর হঠাৎ করেই টের পেলো সশব্দে আবারও হিসু বের হচ্ছে। সম্বিত ফিরে পেলো, বুঝলো ভয়েই মাঝপথে আটকে ছিলো। এবার ভয় কিছুটা কাটতেই বাকিটা হয়ে গেলো।
হিসু শেষ করতেই ভূত ছানাটি বলে উঠলো... তুঁমি কিঁ এঁখনই ঘুঁমিয়ে পঁড়বে।
রুশো বললো কেনো? ভূত বললো না তোমার মাঁ আঁমার নামে গঁল্পে কঁত কিঁছু যেঁ বঁললো সেঁগুঁলো কঁতঁটা সঁত্যি তাঁ দেঁখঁবে না।
রুশো বললো মাতো বলেছে, এ ভূত শুধু গল্পেই থাকে সত্যিকারে কোনো ভূত নেই। আর তাছাড়া বাবাও বলেছে ভূত বলে কিছু নেই।
তাঁহলে আঁমি কেঁ? এ কথা বলেই ভূতের ছানাটি অদৃশ্য হয়ে গেলো। আবার পরক্ষণেই ফিরে এসে বললো.. এইযে দেখো আমি ছিলাম না... আবার এসে পড়েছি।
এসেই আবার দুটো ডিগবাজি খেলো।
আরে তুমি আবার ডিগবাজি খেলে যে.. কাণ্ডটা কি। ভূতছানা বললো.. খিদে পেলে খাবো না বুঝি?
এখনই না খেলে এরমধ্যেই আবার খিদে। বললো রুশো।
ভূতছানা বললো... আমার একটু বেশিই ক্ষিদে পায়। রুশো বললো.. ও..
মা যে বললো ভূতেরা অন্ধকার খায়.. তুমিও খাও নাকি। ভূতছানা বললো না.. শহরের ভেজাল অন্ধকার খেতে ভালো লাগে না। রাতে ঘুঁটঘুঁটে আঁধার না হলে খেয়ে মজা নেই। লোডশেডিং হলে মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। তাও আজকাল কম হচ্ছে। আর তোমরা আবার জেনারেটর চালাও। ঝট করে বাতি জলে ওঠে। এসব চিন্তা করে নিজের বিকল্প খাবার হিসেবে ডিগবাজিই বেছে নিয়েছি।
ঠিক আছে তুমি ডিগবাজি খাও যত পারো.. আমি যাই ঘুমাতে।
না যেও না রুঁশোঁ.. তোমার সঙ্গে গল্প করে খুব মজা পাচ্ছি। আর তা ছাড়া বাথরুম ছেড়ে তুমি গেলে তুমি আর আমাকে দেখতে পাবে না। কারণ আজ আমার বাথরুমেই দর্শনরাত। তাইতো সেই রাত দশটা থেকে ভেন্টিলেটারে বসে আছি। তোমার যদি ঘুম ভাঙে সেই আশায়।
দর্শনরাতটা আবার কি জিনিস? হেসে বললো রুশো।
তুমি জানবে না, ভীষণ নিয়ম নীতির মধ্যে বড় হতে হয়। নড়চড় হলে মায়ের সে কি শাস্তি? সবচেয়ে বড় শাস্তি খেতে দেবে না।
তোমার তাতে চিন্তা কি? তুমি তো ডিগবাজি দিয়েই খেয়ে নিতে পারো।
আরে তার কি জো থাকে... হাত পায়ে মা এমন কিছু করে দেয় যে তুমি হাঁটতে পারবে, হাত নাড়াতে পারবে কিন্তু ডিগবাজি খেতে পারবে না।
তোমার মাতো ভীষণ খারাপ? বললো রুশো।
চেঁচিয়ে উঠলো ভূতছানা। বললো, না... আমার মাকে খারাপ বলবে না। নিয়ম-কানুন তো সবাইকেই মানতে হয়। তা না হলে কী আর ভূতের মতো ভূত হয়ে ওঠা যায়।
আবার হাসি পেলো রুশোর। মনে পড়লো সেদিন বাবা বলেছিলো, বাবা মায়ের কথা মতো চলো... মানুষের মতো মানুষ হও।
এভাবে নানা কথা চলতেই থাকলো ভূত ছানার সঙ্গে।
হঠাৎ বললো এবার চলি। তোমার সঙ্গে খেলার সময় শেষ।
কেনো থাকো না... বললো রুশো।
ভূত ছানা বললো.. নারে বাবা ... তুমি কি আমার ডিগবাজি খাওয়া বন্ধ করতে চাও?
বলতে বলতেই গোটা তিনেক ডিগবাজি খেয়ে নিলো। লাফিয়ে উঠে গেলো ভেন্টিলেটারের কার্নিসে। কাচের ফাঁকা গলিয়ে বেরিয়ে গেলো মামদো ভূতের ছানা।
সকালে রুশোর যখন ঘুম ভাঙলো দেখলো মা.. বড় আপু ও কাজের মেয়ে রাহিলা দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। রুশোর বুঝতে বাকি থাকলো না... হিসু করে গোটা বিছানা ভিজিয়েছে বলেই সবাই এভাবে মুখ টিপে হাসছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৫
এএ