ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

আইজ্যাক অ্যাজিমভের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী | বেস্ট ফ্রেন্ড

অনুবাদ রচনা ~ ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৫
আইজ্যাক অ্যাজিমভের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী | বেস্ট ফ্রেন্ড

মি. অ্যান্ডারসন জিজ্ঞেস করলেন, “জিমি কোথায়, জানু?”
“ওই জ্বালামুখের দিকে গেছে। সমস্যা নেই, রোবাট ওর সঙ্গে আছে।

” উত্তর দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, “কী? ও কি পৌঁছেছে?”
“হ্যাঁ, পৌঁছেছে। এখন রকেট স্টেশনে আছে। টেস্ট-ফেস্ট চলছে। আসলে আমি নিজেও খুব এক্সাইটেড। সেই ১৫ বছর আগে শেষবার দেখেছিলাম। এরপর যে দুয়েকবার দেখেছি সেটাও সেলুলয়েডের পর্দায়, ধর্তব্যের মধ্যে ফেলা যায় না। ”

| অনুবাদ: মহিউল ইসলাম মিঠু

“জিমিও কখনো দেখেনি। ” বললেন মিসেস অ্যান্ডারসন।
“দেখবে কিভাবে? ওর জন্মই তো হয়েছে চাঁদে! পৃথিবীতেও যেতে পারে না। আরে, এজন্যই তো এত খরচ করে আনার ব্যবস্থা করলাম! চাঁদে এই ঘটনা এটাই প্রথম, সম্ভবত। ” খোশমেজাজে বললেন মি. অ্যান্ডারসন।
“খরচটা খুব বেশি। ” ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন মিসেস অ্যান্ডারসন।
“রোবাটের খরচটাও কিন্তু কম নয়!” বললেন মি অ্যান্ডারসন।



লুনার গ্র্যাভিটি মেইনটেইন করার ক্ষেত্রে জিমির জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু রোবাট এক্ষেত্রে জিমির চেয়েও কয়েক ডিগ্রি উপরে। ছুটতে গিয়ে রোবাটের  সাথে কখনোই পেরে ওঠে না জিমি। ধাতব চার পায়ে দৌড়ে জিমির কাছে পৌঁছতে সময়ই লাগল না রোবাটের। কাছাকাছি পৌঁছে জিমির মাথার উপর দিয়ে সুন্দর একটা ডিগবাজি দিল সে। ডিগবাজি দিয়ে ল্যান্ড করল জিমির ঠিক পায়ের কাছে



মিসেস অ্যান্ডারসনের ধারণাই ঠিক, জিমি আসলেই ওই জ্বালামুখের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। জিমির বয়স দশ। কিন্তু বয়সের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা। হাত-পাগুলো একটু বেশিই হ্যাংলা টাইপ। কিন্তু এই হ্যাংলা হাত পায়ের জন্যই জিমি লুনার গ্র্যাভিটি(চাঁদের অভিকর্ষ) যত সুন্দরভাবে মেইনটেইন করতে পারে, পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়। ক্যাঙ্গারুর মতো লম্বা লম্বা লাফে জিমি যখন এগোতে শুরু করে তখন ওর বাবাও তাল মেলাতে পারে না। এখন স্পেসস্যুট পরে আছে জিমি। একটু হোঁৎকা টাইপ লাগছে দেখতে।

জ্বালামুখটা দক্ষিণদিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে গেছে। এখান থেকে আকাশের দিকে তাকালে পৃথিবী দেখা যায়। আকাশের বুকে স্থির হয়ে ঝুলে আছে পৃথিবী নামক গ্রহটা। জ্বালামুখের এপাশটাতে পৃথিবীর আলো সরাসরি পড়ছে, তাই পুরো জায়গাটা পুরোপুরি আলোকিত। চলতে কোনো সমস্যাই হচ্ছিল না জিমিদের।

এই ঢালটা একেবারে মসৃণ। সুষমভাবে উপরে উঠে গেছে, কোনো চড়াই উৎড়াই নেই। তাই স্পেসস্যুট পরেও দৌড়ে উপরে উঠতে কোনো সমস্যাই হচ্ছিল না জিমির।

রোবাটের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জিমি চিৎকার করে বলল, “তাড়াতাড়ি এসো, রোবাট!”

রেডিওর মাধ্যমে জিমির চিৎকার রোবাটের কানে পৌঁছল। যেহেতু রেডিওর মাধ্যমে কথা যাচ্ছে তাই চিৎকার করার দরকারই ছিল না। ফিসফিস করলেও শুনতে পেত রোবাট। যান্ত্রিক চিঁ চিঁ শব্দ করে জিমির দিকে ছুট দিল রোবাট।

লুনার গ্র্যাভিটি মেইনটেইন করার ক্ষেত্রে জিমির জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু রোবাট এক্ষেত্রে জিমির চেয়েও কয়েক ডিগ্রি উপরে। ছুটতে গিয়ে রোবাটের  সাথে কখনোই পেরে ওঠে না জিমি। ধাতব চার পায়ে দৌড়ে জিমির কাছে পৌঁছতে সময়ই লাগল না রোবাটের। কাছাকাছি পৌঁছে জিমির মাথার উপর দিয়ে সুন্দর একটা ডিগবাজি দিল সে। ডিগবাজি দিয়ে ল্যান্ড করল জিমির ঠিক পায়ের কাছে।

“এত শো অফ করার দরকার নেই, রোবাট! কাছাকাছি  থাকো। বেশি দূরে যেও না। ” রোবাটকে শাসন করার ভঙ্গিতে বলল জিমি।
রোবাট আবার চিঁ চিঁ শব্দ করল। এই চিঁ চিঁ’র মানে, “ইয়েস, বস। ”
“হয়েছে! আর ভালো সাজতে হবে না। তোমার কোনো কথাই বিশ্বাস করি না আমি। ” কপট রাগ দেখিয়ে বলল জিমি। তারপর আরেকটু এগিয়ে ঢালের একেবারে চূড়ায় পৌঁছে গেল। এরপর ঢালটা আবার জ্বালামুখের ভেতরের দিকে নামতে শুরু করেছে।

ঢালের এদিকটা অন্ধকার। পৃথিবী ডুবতে ডুবতে ঢালের ওপারে হেলে পড়েছে। মিষ্টি একটা অন্ধকারে ঢেকে আছে চারপাশ। স্নিগ্ধ অন্ধকারটা ভালো লাগছিল জিমির।

বড়রা বলে ঢালের এপাশটা বিপজ্জনক। বিপজ্জনক বলার কারণ সম্ভবত এটাই যে, বড়রা তেমন একটা আসে না এপাশটাতে। কারণ জিমি প্রায়ই এদিকটাতে আসে কখনো বিপজ্জনক কিছুর আভাস পায় নি সে। যে অল্পকয়েকটা পাথর আছে এপাশটাতে, তার প্রত্যেকটাকেই আলাদা আলাদা করে চেনে সে।

আর তাছাড়া রোবাট যতক্ষণ সাথে আছে তখন কি বিপদ হতে পারে তার? রোবাট তার পায়ের কাছে লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে, চিঁ চিঁ শব্দ করছে, শরীর থেকে হালকা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে। এমনকি যদি কোনো আলো নাও থাকে তাতেও সমস্যা নেই। রাডারের মাধ্যমে অন্ধকারের মধ্যেও জিমিকে খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হবে না রোবাটের। রোবাট সাথে থাকতে কোনো সমস্যা হওয়া অসম্ভব।

এমনিতেও রোবাট সবসময়ই জিমির সাথে সাথে থাকে। জিমির চারপাশে গোল গোল ঘুরতে থাকে। অনবরত লাফাতে থাকে। জিমি কোন পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লে ভয় পেয়ে যায়(যদিও রাডার আছে!) বা ভয় পেয়ে যাওয়ার ভান করে, হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করে। মোট কথা রোবাট সাথে থাকতে জিমির কোনো বিপদ হওয়া জাস্ট অসম্ভব।

একবার মাটিতে চুপ করে শুয়ে থেকে ব্যথা পাওয়ার ভান করছিল জিমি। এটুকুতেই ভয় পেয়ে গেল রোবাট। রেডিও সিগন্যাল পাঠিয়ে দিল শহরে, শহরটাকে সবাই লুনার সিটি বলে ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে লুনার সিটি থেকে লোকজন সাহায্য নিয়ে হাজির হয়েছিল। সেবার খুব লজ্জা পেয়েছিল জিমি। এরপর এমন বোকামি আর করেনি সে।

জিমি যখন এসব ভেবে হালকা হালকা লজ্জা পাচ্ছিল তখন তার প্রাইভেট ওয়েভলেংথে সিগন্যাল আসল। রেডিও সিগন্যালে মি. অ্যান্ডারসন বললেন, “জিমি, বাসায় এসো। কথা আছে। ”

বাড়ি ফিরে স্পেসস্যুট খুলে পরিষ্কার হয়ে নিতে হলো জিমিকে। বাইরে থেকে এসে পরিষ্কার হওয়াটা বাধ্যতামূলক। এমনকি রোবাটকেও স্প্রে করে পরিষ্কার করে নিতে হয়। অবশ্য রোবাট ব্যাপারটা বেশ পছন্দ করে। প্রতিবার স্প্রের নিচে দাঁড়ানোর সময় একটু বেশিই আনন্দিত মনে হয় তাকে। এবারও বেশ আনন্দিত চিত্তেই স্প্রের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল সে। চিঁ চিঁ শব্দে গান গাইছিল। শেষে মি. অ্যান্ডারসন হালকা ধমক দিলেন, “চুপ কর, রোবাট!” চিঁ চিঁ সংগীত থামল।

হালকা হাসতে হাসতে জিমিকে বললেন মি. অ্যান্ডারসন, “তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি আমরা। জিনিসটা এখন রকেট স্টেশনে আছে, টেস্ট চলছে। কালই পেয়ে যাবে। ”
“পৃথিবী থেকে?” উত্তেজিত শোনাল জিমির গলা।
“হ্যা, পৃথিবী থেকে। একটা কুকুর। সত্যিকারের কুকুর। একটা স্কচ টেরিয়ার! এই প্রথম কোনো কুকুর চাঁদে আসছে। রোবাটকে আর লাগবে না এখন। এখন থেকে রোবাটের জায়গায় ওই কুকুরটা তোমার সঙ্গে থাকবে। রোবাটকে অন্য কারো কাছে পাঠিয়ে দেব আমরা। তুমি তো অনেক বুদ্ধিমান, তুমি তো বুঝতেই পারছো দুটোকে একসাথে রাখার খরচ অনেক। পোষাবে না আমাদের। ”

মি. অ্যান্ডারসন আশা করছিলেন জিমি কিছু বলবে। কিন্তু জিমি কিছুই বলল না। জিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে অ্যান্ডারসন আবার শুরু করলেন, “সত্যিকারের কুকুর কী জানো? একটা প্রাণি। সত্যিকারের জীবিত প্রাণি। রোবাট তো একটা রোবট-কুকুর, একটা যান্ত্রিক প্রাণি। আর এটা সত্যিকারের কুকুর। তোমার জন্য আনা হয়েছে, সেইইই পৃথিবী থেকে। ”
ভ্রু কুঁচকে জিমি বলল, “ রোবাট যান্ত্রিক প্রাণি নয়, বাবা। ও আমার কুকুর। ”
“হ্যাঁ, ও তোমার কুকুর কিন্তু সত্যিকারের কুকুর নয়। স্টিল আর তার দিয়ে বানানো কুকুর। একটা পজিট্রনিক ব্রেনওয়ালা মেশিন। জীবিত কিছু নয়। ” বোঝানোর চেষ্টা করলেন মি. অ্যান্ডারসন।
“না, বাবা। রোবাটও জীবিত। ও আমার সব কথা শোনে, আমার সব বোঝে। ও খুব ভালো। ” ধীরে ধীরে বলল জিমি।
“না, বাবা। রোবাট একটা মেশিন। ও তোমার কথা শোনে কারণ ওকে এভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে। ” বললেন মি. অ্যান্ডারসন।
“ওই কুকুরের তো স্পেসস্যুট লাগবে, তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু এটা কোনো ব্যাপার না। একবার কুকুরটাকে পেলে রোবাটকে আর ভালোই লাগবে না তোমার। ” উৎসাহ নিয়ে বললেন মি. অ্যান্ডারসন।

জিমি রোবাটের দিকে তাকাল। রোবাট খুব ধীরে চিঁ চিঁ শব্দ করছিল, যেন ভয় পাচ্ছে। জিমি একটা হাত বাড়িয়ে দিল রোবাটের দিকে। হাত বাড়ানো মাত্র এক ছুটে জিমির কাছে চলে আসল রোবাট। রোবাটকে জড়িয়ে ধরে জিমি বলল, “ওই কুকুরটা আর রোবাটের মধ্যে পার্থক্য কী?”
“এটা বোঝানো কঠিন, কিন্তু তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে। ” বললেন মি. অ্যান্ডারসন, “কুকুরটা তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসবে। সত্যিকারের ভালোবাসা। রোবাট শুধু তোমাকে ভালোবাসার অভিনয় করে, সত্যিকারের ভালোবাসা বলে কিছু নেই ওর। ”
“কিন্তু বাবা, আমরা তো জানি না যে কুকুরটার ভেতরে কী আছে। হয়ত ওই কুকুরটাও ভালোবাসার অভিনয় করে। ”
“জিমি, তুমি যখন জীবিত কোনো প্রাণির ভালোবাসা পাবে তখন ঠিকই বুঝতে পারবে। ” ভ্রু কুঁচকে বললেন মি. অ্যান্ডারসন।

জিমিও এমনভাবে ভ্রু কুঁচকাল যে বোঝা গেল সে তার মত বদলাতে রাজি নয়। রোবাটকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে বলল, “ওরা অভিনয় করে কিনা বা কে কেমন অভিনয় করে তাতে কী আসে যায়। আমি তো রোবাটকে ভালোবাসি। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। ”
ছোট্ট রোবট-কুকুরটাকে এর আগে কেউ কোনোদিন এত জোরে জড়িয়ে ধরেনি, এমনকি প্রশিক্ষণের সময়ও না। সে বেশ জোরে চিঁ চিঁ শব্দ করতে লাগল, আনন্দসূচক চিঁ চিঁ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৫
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।