প্রথম যেদিন স্কুলে ভর্তি হলাম ভাবতেও পারিনি এমন ভাঙাচোরা একটা স্কুলে আমি পড়ব। কী বাজে, অন্ধকার ছোট ছোট ক্লাসরুম।
হেডস্যারের রুমে ঢুকতেই দেখি আধময়লা তোয়োলে জড়ানো চেয়ারে হেলান দিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। বাহ্, মাঝবয়সী লোকটার তো খুব মিষ্টি চেহারা!
বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ ইংরেজিতে কথা বললেন হেডস্যার। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম, এমন ভাঙাচোরা স্কুলের হেডস্যার আবার ইংরেজিও বলতে পারে! অবাক কাণ্ড।
শিরিন ম্যাম আমাকে সামনের বেঞ্চের অনেকগুলো মেয়ের পাশে বসিয়ে দিলেন। আমার কাছে বই-খাতা কিছু নেই। সবার সামনে একটা করে খাতা খোলা। হাতে পেন্সিল। আমার পাশে বসা মেয়েটা আমাকে বলল, “অ্যাই তুমি এত ছোট জামা পরেছো কেন?”
আমি বুঝলাম এখানে আমি ছাড়া কোনো মেয়ে হাঁটুর উপর জামা পরেনি। বললাম, “এটা জামা না, স্কার্ট। ”
বাবা স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা ফরম পূরণ করলেন। সম্ভবত ওটাই আমার ভর্তির ফরম। আমাকেও স্ট্যাপল করা কিছু সাদা কাগজ দেওয়া হলো। টুকটাক কিছু শব্দ, কিছু ওয়ার্ডমিনিং আর ট্রান্সলেশন করতে বললেন হেডস্যার। আমি ঝটপট লিখে দিলাম। কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেডস্যার বললেন, “ভেরি গুড!”
বাবা বলছিলেন আমাকে বেবি ক্লাসে ভর্তির কথা। কিন্তু হেডস্যার বললেন, প্রয়োজন নেই। ও প্রি-ওয়ানে টিকে যেতে পারবে। বাবা প্রি-ওয়ানের ফরমই পূরণ করেছেন।
ভর্তি শেষ হওয়ার পর বাবা স্যারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার সোলাইমান। ”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। যে ভদ্রলোক এত ভালো ইংরেজি বলেন তার নাম কিনা সোলাইমান! অবশ্য স্কুলের চেহারার সঙ্গে তার নামটা মানানসই। স্যারের রুম থেকে বের হয়ে বাবা আমাকে নিয়ে অনেকগুলো নীল দরজার একটা দরজা গলিয়ে ঢুকলেন। এটাই আমার ক্লাসরুম।
রুমটা পুরোই এয়ারটাইট বয়ামের মতো। উফ্, নিশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। সারি সারি বিছানো বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসে ছেলেমেয়েরা। কিচির-মিচির শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেল আমার। যেন একটা মুরগীর ফার্মে ঢুকেছি। বাচ্চাদের কেউ কেউ ইউনিফরম পরা আবার কেউ রেগুলার ড্রেস পরা। সবার সামনে চেয়ারে বসে আছেন হালকা-পাতলা গড়নের এক ম্যাডাম। বাসন্তী রঙের সুতি শাড়ি পরেছেন। বাবাকে দেখে হাসিমুখে ম্যাডাম এগিয়ে এলেন। বললেন, “মাত্র ভর্তি করলেন?”
জ্বি। ক্লাস করতে পারবে?
অবশ্যই।
আমার চিবুকে তর্জনী রেখে ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কী বাবু?”
মারিয়া রোজারিও।
বাহ্ খুব মিষ্টি নাম।
হোয়াটস্ ইউর নেইম?
ও ভেরি স্মার্ট গার্ল! আই অ্যাম শিরিন সুলতানা।
ওউউ থ্যাঙ্কস।
শিরিন ম্যাম বাবাকে বললেন, “আপনি ওকে রেখে যান। ক্লাস করুক। ১২টা নাগাদ ছুটি হবে। ”
বাবা বললেন, “ঠিক আছে। আমি আশেপাশেই আছি। ”
আমি লক্ষ্য করলাম, ক্লাস হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে। মুরগীর ফার্ম মনে হচ্ছে না এখন। সবাই আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখছে। কেউ কেউ আমার হাঁটুর দিকে তাকিয়ে আছে। একে অন্যকে ফিসফিস করে আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দিচ্ছে। যে দেখছে সে ফিক করে হাসছে।
শিরিন ম্যাম আমাকে সামনের বেঞ্চের অনেকগুলো মেয়ের পাশে বসিয়ে দিলেন। আমার কাছে বই-খাতা কিছু নেই। সবার সামনে একটা করে খাতা খোলা। হাতে পেন্সিল। আমার পাশে বসা মেয়েটা আমাকে বলল, “অ্যাই তুমি এত ছোট জামা পরেছো কেন?”
আমি বুঝলাম এখানে আমি ছাড়া কোনো মেয়ে হাঁটুর উপর জামা পরেনি। বললাম, “এটা জামা না, স্কার্ট। ”
মেয়েটা ভেংচি কেটে আমার কথাকে বিকৃত করে বলল, “জামা না, স্কার্ট! হি হি হি”..
আমার বড্ড রাগ হলো বাবার ওপর। একে তো পচা একটা স্কুল তার ওপর ছেলেমেয়েগুলোও পচা পচা।
ওই ক্লাসে শিরিন ম্যাম কতগুলো অঙ্ক করালেন। তারপর একটা ঘুড়ি আঁকতে দিলেন। আমি জীবনেও ঘুড়ি আঁকিনি। সেদিন প্রথম আঁকলাম। আমার কাছে স্কেল, রঙ আর জ্যামিতি বক্সের চাঁদা কিছুই ছিল না। পাশের ওই মেয়েটা নিজে থেকেই আমাকে দিল এগুলো। প্রথমে মেয়েটা আমাকে ভেংচি কাটায় রাগ হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর রাগ নেই। বরং ওকে ভালো মনে হতে লাগল। মেয়েটা বলল, “তোমার নাম কী?”
মারিয়া। তোমার নাম?
জোবাইদা।
হাসলাম। আমি ঘুড়ি আঁকছিলাম। জোবাইদা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার লম্বা চুলের ঝুঁটি ধরে নাড়াচাড়া করছিল। আমার টপসের হাতা টেনে বলল, “তোমার চুলগুলো লাল লাল। তেল দাও না? প্রতিদিন তেল দেবে। শুধু শুক্রবার চুল ধোবে। ”
আমি বললাম, “মাঝে মাঝে আম্মু দিয়ে দেয়। ”
তারপর বলল, “এত ফর্সা কেন তুমি? বিদেশিদের মতো দেখতে। পুতুল পুতুল লাগে। ”
আমার মেজাজটা আবারও খারাপ হয়ে গেল। এগুলো কোনো কথা! ঘুড়ি আঁকা শেষ আমার। শিরিন ম্যাম ঘুরে ঘুরে সবার খাতা দেখছেন। আর নম্বর দিচ্ছেন। আমার খাতা দেখে বললেন, “বাহ্, খুব সুন্দর তো!” ১০-এ ৬ পেলাম আমি। সবার খাতা দেখা শেষে শিরিন ম্যাম বললেন, “সবাই ব্যাগ গোছাও। ঘণ্টা পড়লে লাইন ধরে ক্লাস থেকে বের হবে। ”
সবাই হুড়মুড় করে বই-খাতা গোচ্ছাচ্ছিল। নিমেষেই ক্লাসরুমটা শোরগোলে আবার মুরগীর ফার্ম হয়ে গেল। আমার ব্যাগও নেই, বই-খাতাও না। চুপচাপ বসে সবাইকে দেখতে লাগলাম। খেয়াল করলাম এখানকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই শুদ্ধভাষায় কথা বলে না। সবাই কেমন যেন দুষ্টু প্রকৃতির। কারণে-অকারণে হাসে। কেন যেন কাউকেই আমার বন্ধু মনে হলো না।
তখনই শিরিন ম্যাম আমার নাম ধরে ডাকলেন, “মারিয়া, এদিকে এসো। ”
আমি এগিয়ে গেলাম। ম্যাম বললেন, “একটা রাইমস শোনাও তো। পারবে?”
হুম পারব।
আচ্ছা। অ্যাই সবাই চুপ! মারিয়া রাইমস শোনাবে।
ম্যামের কথায় ক্লাস একটুও চুপ হলো না। শিরিন ম্যাম টেবিলের ওপর ডাস্টারের বাড়ি দিয়ে বললেন, “বাচ্চারা চুপ করো। মারিয়া রাইমস বলবে। এখন যে-ই কথা বলবে তাকেই সামনে নিয়ে আসব। ” এবার সবাই চুপ হয়ে গেল। সবার চোখ আমার দিকে।
আমি দু’হাত নেড়ে সুর তুলে রাইমস বলতে লাগলাম—They are ten on the bed and little one said-roll over, roll over. They all rolled over and one fell out..
ঠিক তক্ষুণি ছুটির ঘণ্টা বাজল। আমার রাইমস শেষ না হতেই প্রবল স্রোতের বেগে আমাকে ছাপিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে লাগল সবাই। শিরিন ম্যাম চিৎকার করতে লাগলেন, “অ্যাই আস্তে যাও। পড়ে যাবে। এই একদম ধাক্কধাক্কি করবে না। লাইন ধরো”...
কিন্তু কে শোনে কার কথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাস ফাঁকা হয়ে গেল। শিরিন ম্যাম ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বললেন, “তোমার বাবা নিতে আসবেন তোমাকে। তুমি এই দরজার বাইরে দাঁড়াও। অন্য কোথাও যেও না কেমন। বাবা খুঁজবেন তোমাকে। ”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। শিরিন ম্যামের কথামতো ক্লাসের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গোঁড়ালি উঁচু করে বাবাকে খুঁজতে লাগলাম। উফ! এখানকার ছেলেমেয়েদের কোনো ম্যানার জ্ঞান নেই। কেমন ধাক্কা লাগিয়ে চলে যায়। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আমার মাথায় হাত রাখল। আমি পেছন ফিরে দেখি ফর্সা এক ভদ্রমহিলা।
গোলাপি জর্জেটের শাড়ি পরা ভদ্রমহিলার হাত ধরে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে। ছেলেটার চোখ বাদামী।
ছেলেটা বলল, “আম্মু ও আমাদের নতুন ক্লাসমেট। ”
বুঝলাম ও-ই ওর আম্মুকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে।
ভদ্রমহিলা আমার চিবুক টেনে বললেন, “নাম কী মামনি?”
মারিয়া রোজারিও।
ও বাব্বা। তাই? কে নিতে আসবে?
বাবা।
বাসা কোথায় তোমার?
সাদা-আর সবুজ রঙের বিল্ডিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরে।
মিষ্টি হাসি হেসে ওই আন্টিটা বললেন, “তাই!”
তারপর আন্টি ছেলেটার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করলেন। মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে ছেলেটাকে হঠাৎ বললেন, “এখানে দাঁড়াও। আম্মু আসছি এক্ষুণি। ”
আন্টিটা অনেকগুলো নীল দরজার একটার ভেতর ঢুকলেন।
ছেলেটা আমাকে বলল, “তুমি আমার পাশে বসতে পারো। আমার কাছে চাঁদা আছে। আম্মু আমাকে পুরো জ্যামিতি বক্স কিনে দিয়েছে। ঘুড়ি আঁকতে পারবে। আমার রঙও ইউজ করতে পারো। ”
আমি বললাম, “আমার রঙ আছে। তোমার নাম কী?”
সুপ্ত।
আমি হাসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুপ্তর আম্মু চলে এলেন। বললেন, “তোমার বাবা এখনো আসেননি বাবু?”
উহুঁ।
আমাদের বাসায় যাবে?
উহুঁ।
তাহলে তুমি এখানেই দাঁড়াও। এক্ষুণি হয়ত বাবা চলে আসবেন।
আচ্ছা।
আন্টি সুপ্তর হাত ধরে গেটের দিকে হাঁটতে লাগলেন। কী ভেবে সুপ্ত আন্টির হাত ছেড়ে আমার দিকে দৌড়ে এলো। বলল, “কাল তুমি আমার পাশে বসবে। ”
আচ্ছা।
দু’আঙুলে জোরে আমার গাল টিপে সুপ্ত বলল, “তুমি না দেখতে পুতুলের মতো। বিদেশি পুতুলের মতো। ”
বলেই এয়ারপ্লেনের মতো দু’হাত ছড়িয়ে গেটের দিকে ছুটে গেল ও। ওরা বেরিয়ে যেতেই বাবা হন্তদন্ত হয়ে গেট দিয়ে ঢুকলেন। আমার কাছে এসে বললেন, “দেরি হয়ে গেছে মামনি? সরি। ”
না বাবা, দেরি হয়নি।
স্কুল কেমন লাগল?
ভালো বাবা। আমার একটা বন্ধু হয়েছে।
তাই? কী নাম।
সুপ্ত।
বাহ্।
বাবা, আমি কি দেখতে পুতুলের মতো?
হুম, তুমি তো আমার ছোট্ট পুতুল। আমার বিলেতি পুতুল!
আমি বাবার হাত ধরে দু’পায়ে নাচতে নাচতে বাড়ির পথে এগোলাম। আর গাইতে লাগলাম—They are ten on the bed and little one said - roll over, roll over. They all rolled over and one fell out..
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
এসএমএন/টিকে