স্কুল থেকেই বইগুলো বুকে চেপে বাসায় ফিরেছে সামিন। আজ সে বই ব্যাগে ঢোকায়নি।
বাসায় ঢুকেই দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে সামিন তার বইগুলো দেখিয়ে উত্তেজিতভাবে বলল, দেখো মা! আমার নতুন বই!
তারপর প্রাণভরে বইয়ের ঘ্রাণ শুকে নিয়ে বলল, কী সুন্দর ঘ্রাণ! নতুন বইয়ের নতুন ঘ্রাণ।
মা হাসলেন।
সামিন এবার ক্লাস ফাইভে উঠেছে। বছরের প্রথম দিনই স্কুলে পাঠ্যপুস্তক উৎসব ছিল। সে নতুন ক্লাসের সবগুলো চকচকে রঙিন নতুন বই পেয়ে গেছে। সেই আনন্দ রাখার জায়গা পাচ্ছে না সে।
মা বললেন, স্কুল থেকে এসেছ, যাও, হাতমুখ ধুয়ে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নাও। বিকেলে একটু খেলে এসে সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসবে। এবার তুমি ক্লাস ফাইভে। পিএসসি পরীক্ষা। নতুন বই পেয়ে খালি ঘ্রাণ শুকলেই তো হবে না, বছরের শুরু থেকেই পড়াশোনা শুরু করতে হবে। না হলে পরে তুমি পিছিয়ে পড়বে।
সামিন করুণভাবে বলল, আজ না পড়লে হয় না মা? আজ আমি বইগুলো জড়িয়ে ধরে ঘুমাব। পড়ব না। আর কিছুদিন পরে পড়ি। কিছুদিন আগেই তো ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। এতদিন শুধু পড়লামই তো। মাত্রই তো নতুন বছর শুরু হল। এখন না পড়ি?
মা কঠিনভাবে বললেন, না সামিন, এমন করলে লেখাপড়া হবে না। আজ থেকেই পড়াশোনা শুরু করতে হবে।
সামিনের খুব মন খারাপ হলো। কান্না পেয়ে গেলো। যে নতুন বইগুলো এক মুহূর্তের জন্য নামাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, সেগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হলো। সে রাগ করে সত্যিই কাঁদতে কাঁদতে আর চিৎকার করতে করতে বইগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো। মা অনেক চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারলেন না। এরপর তিনি সামিনের গালে একটা চড় কষিয়ে বললেন, লেখাপড়ার কোনো দরকার নেই তোমার। মূর্খ হয়ে থেকো। আর বেয়াদবি যা শিখেছ তা তো চিন্তাই করা যায় না। আজ আসুক তোমার বাবা, দেখাচ্ছি।
নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে খানিকক্ষণ কাঁদলো সামিন। তারপর তার খুব কষ্ট হতে লাগলো বইগুলোর জন্য। ছেঁড়া বইগুলোর দিকে তাকিয়ে তার কান্না পেয়ে গেলো। সে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, মা, আমি এখন নতুন বই কোথায় পাবো?
মা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, আমি কী জানি? জেদ করে তো খুব বই ছিঁড়লে।
কথা বলতে বলতে কলিংবেল বেজে উঠলো। সামিন দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। মাসুদ এসেছে। তার বুকে চেপে ধরা নতুন বই। মাসুদ সামিনদের বুয়ার ছেলে। সামিনের বয়সী। লেখাপড়া করে। সে-ও এবার ফাইভে উঠেছে। প্রায়ই সে এ বাসায় আসে।
সামিনকে দেখে মাসুদ তার বইগুলো দেখিয়ে বললো, তুমিও নতুন বই পাইছ না? কী সোন্দর বই, তাই না? কী সোন্দর গন্ধ!
মাসুদের কথা শুনে সামিনের আরও বেশি মন খারাপ হয়ে গেলো। তার দুই চোখে আবার পানি চলে এলো। সে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে মায়ের কাছে গেলো। মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মাসুদের হাতে নতুন বই দেখে বললেন, তোমার বই আর সামিনের বই তো এক, তাই না মাসুদ?
মাসুদ বললো, জে।
তারপর সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, সামিন কান্দে ক্যান? আজ তো সবাই অনেক খুশি। সবাই আজ নতুন বই পাইছে।
মা উত্তর দিলেন না। বুয়া ঘর ঝাড় দিচ্ছে। তাকে ডেকে বললেন, শোনো মাসুদের মা, আমি সামিনের জন্য পুরনো বই জোগাড় করে রেখেছিলাম। সেগুলো আমি মাসুদকে দিয়ে দিচ্ছি। নতুন বইগুলো সামিনকে দিয়ে দাও।
মাসুদ কথাটা শুনে চমকে উঠলো। তার বইগুলো বুকে চেপে ধরে বললো, না না, আমি আমার নতুন বই দিমু না।
সামিনের মা কঠিন গলায় বললেন, দেবে। আমি তো তোমাকে আরেক সেট বই দিয়ে দিচ্ছিই। মাসুদ বলল, ক্যান? সামিনও তো নতুন বই পাইছে। ওরটা কই? মা বললেন, সেটা তোমার জানার বিষয় না।
তারপর তিনি জোরাজুরি করে মাসুদের কাছ থেকে তার নতুন বইগুলো কেড়ে নিলেন। সামিনের পড়ার টেবিল থেকে পুরনো বইগুলো এনে মাসুদের হাতে দিয়ে বললেন, নাও।
মাসুদ চিৎকার করে কাঁদছে। তার কান্না কিছুতেই থামছে না। সামিনেরও কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে আর মাসুদ খেলার সাথী। মাসুদের বই কেড়ে নিয়ে তাকে দেওয়ার ব্যাপারটা তার একদম ভালো লাগছে না। সে মাকে বললো, মা, মাসুদেরও তো নতুন বই পড়তে ইচ্ছে হয়। তুমি ওরগুলো আমাকে দিলে ও নতুন বই কীভাবে পাবে?
মা কারোর কথা শুনলেন না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। সামিন কোনো উপায় না দেখে বাবাকে ফোন করলো। কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে সবকিছু বললো। বাবা বললেন, একটুপরে তিনি বাসায় চলে আসবেন।
ঘণ্টা দুয়েক পর বাবা বাসায় ফিরলেন। মাসুদ তখনও হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফোঁপাচ্ছে। বাবা এসে মাকে বললেন, মাসুদের বইগুলো ওকে দিয়ে দাও।
মা বললেন, না।
তারপর বললেন, তোমার ছেলে কী বেয়াদবি শিখেছে জানো? মায়ের সামনে বই টেনে ছিঁড়ে ফেললো। ওকে এবার শাসন করো।
বাবা চশমা ঠিক করে নিয়ে বললেন, ও বেয়াদবি করেছে ঠিক। তবে এটাও ঠিক যে তুমি ওকে বছরের শুরুতেই পড়াশোনা করার জন্য চাপাচাপি করে অন্যায় করেছ। তোমার অন্যায়ের কারণেই ও বেয়াদবি করেছে।
তারপর বাবা সামিনের পড়ার টেবিল থেকে মাসুদের নতুন বইগুলো নিয়ে তার হাতে দিয়ে এলেন। বললেন, তোমার বই তোমারই থাকবে মাসুদ।
সামিন এসে বললো, কিন্তু আমার বইয়ের কী হবে বাবা?
বাবা তার ব্রিফকেস থেকে একসেট নতুন বই বের করে বললেন, এই যে তোমার বই। আমি স্কুলে গিয়ে তোমার টিচারকে বলে নিয়ে এসেছি।
তারপর তিনি দুই হাতে মাসুদ আর সামিনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বছরের শুরুতে কেউ মন খারাপ করবে না। আজ নিউ ইয়ার না? আর এখন কাউকে পড়তে হবে না। এখন শুধু নতুন বইয়ের ঘ্রাণ শোকা আর আনন্দ করা।
তারপর তিনি সামিন আর মাসুদকে একইরকম দুটো নতুন স্কুলব্যাগ দিয়ে বললেন, তোমাদের নিউ ইয়ার গিফট।
সামিন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ বাবা।
এরপর সে মাসুদের দিকে তাকাল। তারপর দু’জন মিলে একসঙ্গে বলে উঠলো, হ্যাপি নিউ ইয়ার!
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৫
এএ/