আনিকা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ভাষা আন্দোলনের কথা সে বইয়ে পড়েছে।
২১শে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে আনিকার বাবা বেশকিছু ফুল কিনে এনেছেন। তার মা সেই ফুল দিয়ে একটি মালা তৈরি করেছেন। আগামীকাল খুব সকালে তারা মালাটি নিয়ে শহীদ মিনারে যাবে। আনিকা তার বাবা-মায়ের সাথে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়লো। বাবার সাথে সে ফুলের মালা নিয়ে যাচ্ছে শহীদ মিনারে। আনিকাদের মতো অনেকেই ফুল এবং ফুলের মালা হাতে নিয়ে শহীদ মিনারে যাচ্ছে। শহীদ মিনারে ফুল দিতে পেরে আনিকা ভীষণ খুশি।
২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আনিকার অনেককিছু জানার কৌতূহল। সে তার বাবার কাছে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে চায়। জানতে চায় ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল, কীভাবে আন্দোলন হয়েছিল, আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন, তাদের পরিচয় কী ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি.....। তার বাবা একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন।
আনিকার বাবা তাকে বললো, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের বেশিরভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। নানান অপকৌশলে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতো। তারা এই শোষণের কাজকে দীর্ঘ করার জন্য বেশকিছু পথ বেছে নেয়। তার মধ্যে একটি হলো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা। অথচ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৫৬ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা আর মাত্র ৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন হয় সেটাই ছিল ভাষা আন্দোলন। একুশের চেতনাই বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের প্রেরণা।
বাংলা আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা। এই ভাষাকে রক্ষার জন্য সেই সময় ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষসহ পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভাষা আন্দোলনে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তারা হলেন- রফিক উদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ।
শহিদ রফিক উদ্দিন আহমদ বাবার সাথে প্রেস পরিচালনায় যোগ দেন। তার গ্রামের বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইড় থানার পারিল (বতর্মানে যার নামকরণ করা হয়েছে রফিকনগর) গ্রামে। শহীদ আবুল বরকত ভারতীয় উপমহাদেশের (অবিভক্ত) মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। ক্যানসারে আক্রান্ত শাশুড়িকে চিকিৎসা করানোর জন্য ময়মনসিংহ হতে ঢাকাতে আসেন শহীদ আব্দুল জব্বার। গ্রামে তিনি দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ছোটখাট একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করতেন। শহীদ শফিউর রহমান ঢাকায় হাইকোর্টে চাকরি করতেন। তার বাড়ি ছিল অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের হুগলী জেলার কোন্নগর গ্রামে।
আনিকার বাবা আরও বললো, সারাবিশ্বের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এখন চেষ্টা করা হচ্ছে। মাতৃভাষার গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য বর্তমানে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো এর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমাদের উচিত মাতৃভাষাকে সম্মান করা। আমরা সবসময় চেষ্টা করবো সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহার করতে।
ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আনিকা বাবার মুখ থেকে অনেক কিছু শুনেছে। এসব কথা শুনে ভাষা শহীদদের প্রতি তার মন শ্রদ্ধায় ভরে যায়। আনিকা তার বাবাকে অজান্তেই প্রশ্ন করে বসলো। বাবা, তুমি কেন আমাকে ইংরাজি ভাষা ভালোভাবে শিখার জন্য বকাবকি কর? আমি তো এখনো বাংলাভাষা ভালোভাবে শিখতে পারিনি। আর তুমি তো কথা বলার সময় শুধু ইংরাজি শব্দ ব্যবহার কর। আনিকার বাবা এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন তা সে ভাবতেও পারেনি। বাবা মেয়ের এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ থাকলেন। ভাবলেন বদলাবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
এএ/