ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

বোবা বাবুর বোকামি | শিশির মনির

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৬
বোবা বাবুর বোকামি | শিশির মনির

বোবা বাবু। আমাদের পাড়ার সবচে ধনী লোক।

বিশাল অর্থ-কড়ির মালিক। বড়লোক হলেই কী ! লোকটা বড্ড কৃপণ। কাউকে তো একটি পয়সা দেয়ই না বরং নিজেও খরচ করতে চায় না। এমনকি আধ পয়সা হাতছাড়া করার আগে একশোবার ভেবে নেয়। এমনই এক মানুষ আমাদের বোবা বাবু।

বোবা বাবুর নামটির পেছনে একটি মজার কাহিনী আছে। ছোট্ট বাবুরা জন্মের পর পরই নরম নরম শব্দে কান্না করে। অথচ বোবা বাবু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর চিমটি পরিমাণও কান্না করেনি। শুধু কী তাই? বোবা বাবু গুণে গুণে দু’বছর পর্যন্ত মুখ ফুটে কোনো শব্দও করেনি। কারও সঙ্গে কথাও বলেনি। সবাই তখন ধরে নিয়েছিল সে কখনও কথা বলতে পারবে না। পাড়ার দুষ্টু লোকেরা তখন বোবা বাবু নামটি জুড়ে দেয়। সেই থেকে তার নাম বোবা বাবু।

কিন্তু কী অবাক কাণ্ড! দু’বছর বয়স পেরোতেই বোবা বাবু কথা বলতে শুরু করে। এতে বোবা বাবুর বাবা-মা তো বটেই পাড়াপড়শিরা সবাই অবাক বনে যায়। অবাক হলেই কী হবে? বোবা বাবু নামটি সবার মুখে মুখে রয়ে যায়। সবাই বোবা বাবু নামেই ডাকতে থাকে।

বোবা বাবুর বয়স এখন ৫২ বছর। বাড়িতে তিনি আর তার স্ত্রী থাকেন। দুই ছেলেই বিলেতে পড়াশোনা করে। পাড়ার লোকজন ভাবে বোবা বাবু বুঝি খুব চালাক লোক। আসলে বোবা বাবু লোকটা মোটেও চালাক নয়। বরং ঢের বোকা। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই তার বাড়ি। এ কারণে আমি বোবা বাবুর অনেক বোকামি সহজে দেখতে পাই।

একদিন বাবুর স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেশি টাকা নষ্ট হওয়ার ভয়ে স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নেয়নি। কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। কবিরাজ বাবুর স্ত্রীকে দুটো তাবিজ দেয়। কবিরাজ তাবিজগুলো গলায় ঝুলিয়ে রাখতে বলে। বাবুর স্ত্রী কবিরাজের কথামতো গলায় তাবিজও ঝুলায়। আর এতে বাবু বেজায় খুশি। অল্প টাকায় চিকিৎসা খতম!

কিন্তু অসুখ তো কমেই না বরং দু’দিন না যেতেই অসুখটা আরও বেড়ে যায়। এবার বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের কাছে নেয়। ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে অনেকগুলো ওষুধ লিখে দেয়। পাড়ার দোকানে সব ওষুধ পাওয়া গেলো না। এবার মহা ঝামেলায় পড়েন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো শহরের ফার্মেসিতে ওষুধগুলো পাওয়া যায়। বোকা বাবু একটি দোকানের খোঁজও পায় যেখানে সবচেয়ে কম দামে ওষুধ মেলে। তবে সে দোকানটি শহরের শেষ প্রান্তে, ম্যালা দূরে। পরদিন ভোরে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাবু শহরের পথ ধরেন।

মাথার উপর বিশাল গোলাকৃতির কালো মোটা কাপড়ের ছাতা। আর ডান হাতে ছাতার লম্বা হাতল। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত প্যান্ট মোড়ানো। পায়ে বহু পুরনো প্লাস্টিকের লাল স্যান্ডেল। ইয়া বড় বড় কদম ফেলে হেঁটে চলছেন বোবা বাবু। একনাগাড়ে বৃষ্টির কারণে পথ খুবই পিচ্ছিল। নয়-ছয় হলেই যেকোনো মুহূর্তে কোমর লেপ্টে মাটিতে পড়ে যাওয়ার দুরন্ত সম্ভাবনা আছে। তাই সাবধানে পা ফেলেন।

দুপুর নাগাদ কাঙ্ক্ষিত ফার্মেসির সামনে এসে পৌঁছেন। বলা যায় একটু আশাহত হলেন। ফার্মেসি বন্ধ। চাইলে অন্য ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে পারেন, কিন্তু এই ফার্মেসিতে কিছুটা কম দামে পাওয়া যাবে। এ আশায় ফার্মেসির সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন।

ফার্মেসির সাইনবোর্ডে একটা মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। কল করবেন কিনা বুঝে উঠতে চেষ্টা করেন। কল করলেই ঘ্যাচাং করে টাকা কেটে যাবে। এটা ভাবতেই যেন বুক আঁতকে ওঠে। শেষমেশ কী যেন ভেবে ফার্মেসির নম্বরে কল চাপেন। অপর পাশ থেকে উত্তর এলো- ‘আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি এখন বন্ধ আছে। ’ বাবু ভাবেন ভালোই হয়েছে। ফার্মেসি একটু পর এমনিতেই খুলে যাবে। আমার টাকাটা তো বাঁচলো! মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলেন।

এতোখানি পথ হেঁটেছেন। তারপর দু’ঘণ্টা ধরে ফার্মেসির সামনে দাঁড়ানো। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। আশেপাশে বসার মতো কোনো জায়গা নেই। ক্ষুধাও পেয়েছে ভীষণ। রেস্তেরাঁয় খেলে ম্যালা টাকা খরচ হবে। খামোখা এতো টাকা খরচ করার কী দরকার বাপু? বাম কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দুই ঢোক পানি গিললেন। তারপর আরেকটু বামে সরে এসে ফের স্থির হয়ে দাঁড়ালো।

সন্ধ্যে ছুঁই ছুঁই। এখনও ফার্মেসি খোলার নামগন্ধ নেই। মসজিদের মাইকে আজান পড়ে গেলো। হেঁটে বাড়ি ফিরতেই কমপক্ষে চার ঘণ্টা তো লাগবেই। বোবা বাবু বেশ চিন্তায় পড়লো। এমন সময় ফার্মেসির সামনে একটি সিএনজি এসে থামে।

আপনি কী এই দোকানের লোক? বোবা বাবু সিএনজির পাশে এসে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, দাদা আমি দোকানের মালিক। উত্তর শুনে বোবা বাবুর মন আনন্দে ভরে উঠে।

দুঃখিত, আমি বাসায় মানিব্যাগ রেখে এসেছি। আপনার কাছে কি দুশো টাকা হবে? লোকটা বাবুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে।

বোবা বাবু ভাবলেন আমি তো দুশো টাকার বেশি ওষুধ নেব। লোকটাকে টাকা দেওয়া যেতেই পারে। দ্রুত টাকা বের করে দেন। লোকটা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নেন। ড্রাইভারকে ভাড়া বুঝিয়ে এসে দোকানের তালা খোলায় মনোযোগ দিলেন।

মোট তিনটে তালা। লোকটা একে একে সব তালা খোলেন। সাটার খোলেন। বাবু দোকানের ভেতর তাকালেন। ভেতরে তাকাতেই আশ্চর্য হলেন। ভীষণ আশ্চর্য !
কী দাদা, এটা কাপড়ের দোকান?
হ্যাঁ, দাদা। নতুন দোকান। দু’সপ্তাহ হলো খুলেছি। ব্যস্ততার কারণে নতুন সাইনবোর্ড লাগাতে পারিনি।
জবাব পেয়ে বোবা বাবু বললেন– তাহলে ফার্মেসি?
ফার্মেসির মালিক স্থান বদল করেছেন। ফার্মেসি পাঁচ কিলো দূরে।
মুখ থেকে আর কোনো কথা বেরুলো না বোবা বাবুর। নিরস মনে হাঁটতে শুরু করলেন। একটু এগোতেই দুশেঅ টাকার কথা মনে পড়ে। ফিরে এসে দোকানির কাছে টাকা চান। দোকানি লোকটার হাতে লুঙ্গি ধরিয়ে দিয়ে বলেন ‘দাদা, এটা নিয়ে যান। ক্যাশে কোনো টাকা নেই। জানেন তো, আমি ভুল করে মানিব্যাগ রেখে এসেছি। ’ বোবা বাবুর মুখটা আরও কালো হয়ে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৬
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।